জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা
জানার জন্য শিক্ষা বলতে সেই শিখন প্রক্রিয়াকে বােঝায়, যা শিক্ষার্থীকে বিশ্বজগতের নানান বস্তু সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ‘The World Education’ : Today and Tomorrow-তে শিক্ষার যে চারটি মূল উদ্দেশ্য নিরূপণ করা হয়, তার প্রথমটি জানার জন্য শিক্ষা। বর্তমান যুগ জ্ঞান বিস্ফোরণের যুগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বর্তমান যুগের হাতিয়ার। পৃথিবীর বিশাল বিপুল জ্ঞান সম্ভার ইন্টারনেটের দৌলতে আজ হাতের মুঠোয়। সুবিশাল পৃথিবী আজ ‘গ্লোবাল ভিলেজ”। জ্যাক্স ডেলর শিক্ষার্থীর জীবনে জ্ঞানকে ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করতে বলেছেন। না হলে আধুনিক বিশেষধর্মীতার যুগে তাল মেলানো কঠিন হবে। তাঁর মতে, এই ব্যাবহারিক জ্ঞান শিক্ষার্থীকে পরবর্তীকালে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিতে পরিণত করবে যে কি না সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
জ্ঞানার্জন একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া যার সাহায্যে স্মৃতি, কল্পনা, বিচারবুদ্ধি, সমস্যাসমাধানের ক্ষমতা বিকশিত হয়। অবিরাম অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে এটি সম্ভব। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ এই অভিজ্ঞতা অর্জন প্রক্রিয়াকে সুদৃঢ় করে, জ্ঞান অর্জন যেমন একটি প্রক্রিয়া, একই সঙ্গে জ্ঞান অর্জন এক ধরনের উদ্দেশ্যপূরণ। এই অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী জীবনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। শিক্ষার এই স্তম্ভের মাধ্যমে শিক্ষার্থী জড় প্রকৃতি, মনুষ্য প্রকৃতি, তার ইতিহাস ও পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে সাহায্য পায়।
অতীতের শুধুমাত্র কিছু তথ্য নির্ভর, সাংকেতিক বিষয় ধর্মী, পুনরাবৃত্তিমূলক বিষয়বস্তু যার পরবর্তী বাস্তব জীবনে তেমন গুরুত্ব নেই এমন পাঠক্রমকে বাতিল করে বাস্তবধর্মী পাঠক্রমের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষার উদ্দেশ্য হল বিষয়বস্তুকে অর্থপূর্ণ করে জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে উপস্থাপন করা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর মধ্যে নিরপেক্ষ চিন্তনের ক্ষমতা (independent thinking) এবং যুক্তিনির্ভর মানসিক প্রক্রিয়ার (exercise of rational thought) উন্মেষ ঘটানো। চিন্তন ক্ষমতা শিক্ষার্থীর শিখনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং বিমূর্ত জ্ঞান আহরণে সাহায্য করে। অপরদিকে সঠিক পরিবেশে শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভ হলে তার চিন্তন ক্ষমতার বিকাশ ঘটে এবং সে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বা মত প্রকাশে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। চিন্তন প্রক্রিয়া দুই প্রকার- আরোহী (inductive) অবরোহী (deductive).
দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি: বিভিন্ন বিশিষ্ট দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদগণ জ্ঞানকে বিভিন্নভাবে আলােচনা করেছেন─
(১) দার্শনিক জন ডিউই-এর মতে: জ্ঞান হল বস্তুর অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি। শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তার ফলে তার মধ্যে যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তাই হল জ্ঞান।
(২) শিক্ষাবিদ স্বামী বিবেকানন্দ-এর মতে: মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশই হল শিক্ষা।
জানার জন্য শিক্ষার বিভিন্ন উপাদান
বিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রক্রিয়া যদি শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীর মধ্যে এই চিন্তনের সঠিক বিকাশের লক্ষ্যে থাকে তবে উপযুক্ত নাগরিক তৈরি হয়। এ ছাড়াও শিশুমনের একাগ্রতা জ্ঞান আহরণের অন্যতম উপাদান। বিদ্যালয়ে বিভিন্ন শিক্ষামূলক কাজের মধ্য দিয়ে ধ্যান অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর একাগ্রতাকে বাড়ানাে যেতে পারে, অপর আর-একটি জ্ঞানার্জনের মূল উপাদান হল স্মৃতি। স্থায়ী স্মৃতি শিক্ষার্থীর জীবনের বিভিন্ন সমস্যাসমাধানে সহায়তা করে। ফলে সঠিক পাঠাভ্যাস ও অভিজ্ঞতার সঞ্চার ঘটিয়ে শিক্ষার্থীর জীবনে জ্ঞানের ব্যাবহারিক রূপ পায়। এই দিকে বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক এবং অভিভাবককে সচেষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে জ্ঞানার্জনের শিক্ষা’ বা জানার জন্য শিক্ষা ব্যক্তিকে তার নিজের সঙ্গে বস্তুজগতের যে সম্পর্ক বর্তমান, তা উপলদ্ধি করতে সহায়তা করে।
জ্ঞানার্জনের জন্য শিখনের বৈশিষ্ট্য
(১) জ্ঞানার্জন: শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সর্বকালের সকল দেশের শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা।
(২) তথ্যের সমষ্টি: জ্ঞান হল বিভিন্ন ধরনের তথ্যের সমষ্টি, যা ব্যক্তির মনে সংরক্ষিত থাকে এবং উপযুক্ত সময়ে ব্যবহার করা যায়।
(৩) বিকাশগত বৈশিষ্ট্যকে গ্রভাবিত করা: জ্ঞান ব্যক্তির সকল বিকাশগত বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
(৪) জ্ঞানের সামান্যীকরণ ও সঞ্চালন: জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল জ্ঞানের সামান্যীকরণের সঙ্গে সঙ্গে তার সঞ্চালন।
(৫) কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি: জ্ঞান অর্জন প্রতিটি ব্যক্তির কর্মদক্ষতার বৃদ্ধি ঘটায়।
(৬) সঙ্গতিবিধান: জ্ঞান ব্যক্তিকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গতিবিধানের উপযােগী করে গড়ে তােলে।