সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধতোর বিশ্বে ইতিহাসের সবচেয়ে আলোড়নকারী ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। একে একে ফরাসি, জাপানি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। হো-চি-মিন এই যুদ্ধে আমিতো নেতৃত্ব দেন এবং ভিয়েতনামা বাসিকে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। তিনি ছিলেন ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের পথপ্রদর্শক ও প্রাণপুরুষ।
ভিয়েতনামের যুদ্ধে হো-চি-মিনের ভূমিকা
১. ভিয়েতনামের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন
ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন আন্নামের সম্রাটের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইন্দ্রচীনের উপর ফরাসি আধিপত্য কায়েম করেন। হো-চি-মিন প্রথম জীবন থেকে এই ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী ছিলেন। তিনি ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপশহীন লড়াইয়ের লক্ষ্যে ভিয়েতনাম ওয়ার্কার্স পার্টি ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গঠন করেন।। পরবর্তীকালে এই সংগঠন ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত হয়।
২. সাম্যবাদী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দান
হো-চি-মিন ছিলেন সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী এক কমিউনিস্ট নেতা। তিনি ভিয়েতনাম ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্ব দানের মধ্যে দিয়ে ইন্দোচীনের শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীকে সংঘবদ্ধ করেন। ইন্দ্র চীনের এই সমস্ত শ্রমজীবীদের নিয়ে তিনি এক সাম্যবাদী বিদ্রোহের সূচনা ঘটায়। এই বিদ্রোহ ছিল ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামাবাসী প্রথম সরব প্রতিদান। যদিও শেষ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল।
৩. ভিয়েতমিন গঠন
ভিয়েতনামের মুক্তি কামিদের নিয়ে হো-চি-মিন লীগ ফর দি ইন্ডিপেন্ডেন্টস ইন ভিয়েতনাম গড়ে তোলেন। এই সংগঠনটি সংক্ষেপে ভিয়েতমিন নামের সুপরিচিত হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট ও জাতীয়তাবাদীরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করায় ভিয়েতমিন জাতীয়তাবাদী সংগঠনের রূপ নেয়। জাতীয়তাবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যে সেতুবন্ধন করে এই সংগঠনটি। এ প্রসঙ্গে ব্রায়ান ক্লোজিয়ার বলেছেন যে, “ফরাসি ঔপনিবেশিককতাবাদকে প্রতিরোধে লক্ষ্যে সাম্যবাদ ও জাতীয়তাবাদ একই ধারায় মিশে যায়।”
৪. জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই লড়াই
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির কাছে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্রান্স ইন্দ্রচীন থেকে সরে এলে জাপানের সেখানে নিজের আধিপত্য গড়ে তোলে। ফলে এবার হো-চি-মিন নেতৃত্বে ভিয়েতমিনরা জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে মিত্রশক্তির কাছে অক্ষ জোটের পরাজয় ঘটলে জাপানে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৪ আগস্ট। ইন্দ্রজিৎ সহ সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে জাপানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এই সুযোগে ভিয়েতনাম মুক্তি ফৌজ ও হ্যানয় দখল করে ২৯ আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে।
৫. ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন
জাপানিদের ফেলে যাওয়ায় অর্থশাস্ত্রের সাহায্যে হো-চি-মিন আন্নাম ও টংকিং দখল করে এবং হ্যানয়ে স্বাধীন ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠন করেন ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ২ সেপ্টেম্বর। এদিকে কুয়োমিনতাং চিনো উত্তর ভিয়েতনাম এবং ব্রিটেন দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যায়। কুয়োমিনতাং চীন হো-চি-মিনের হাতে উত্তর ভিয়েতনাম ছেড়ে গেলেও দক্ষিণ ভিয়েতনামের ব্রিটেন ফরাসি আধিপত্য পূর্ণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়ে যায়। যাই হোক হো-চি-মিনের দৃঢ়তার জন্য ফ্রান্স ভি এডমিনের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১ মার্চ বাধ্য হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স ভিয়েতনামকে ইন্দ্রচীন ফেডারেসন ও ফরাসি ইউনিয়নের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৬. ফরাসি আগ্রাসন প্রতিরোধ
ভিয়েতমিনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও ফ্রান্স ভিয়েতনামের সমগ্র অংশে নিজের ক্ষমতা পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। হাইফং অঞ্চলে ফ্রান্স নিরবিচারে বোমা বর্ষণ করলে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর এ প্রায় ছয় হাজার নিরীহ আসামরিক ভিয়েতনাম বাসি মারা যায়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ভিয়েতনাম বাহিনী ফরাসি অধিকৃত টংকিং গেরিলা আক্রমণ চালায় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর। দশটা ছাব্বিশ এতে ৪০ জন ফরাসি মৃত্যু হয়। ২০০ জন ফরাসি কে অপহরণ করা হয়। ইন্দ্রচিন শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধ।
৭. চীন ও রাশিয়ার সাহায্য লাভ
তিন বছর ধরে টানা যুদ্ধ চলার পর ফরাসিবাহিনী হতা দম্ভ হয়ে পড়ে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ কূটনীতির আশ্রয় নেয়। তারা ইন্দ্রচীনের ফ্রান্স সম্রাট বাও-দাইয়ের নেতৃত্বে এক প্রতিদ্বন্দ্বী স্বাধীন সরকার গঠন করে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে। ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃটেনের মতো পশ্চিমে শক্তি গুলি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি। পুঁজিবাদী দেশগুলির এই ভূমিকায় নবগঠিত চিহ্নের প্রজাতান্ত্রিক সরকার ও রাশিয়ায় প্রামাদ গোনে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাম্যবাদের প্রভাবে অখুন্ন রাখার লক্ষে তারা হো-চি-মিনের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
৮. দিয়েন-বিয়েন-ফু ঘটনা : ফ্রান্সের চূড়ান্ত পরাজয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে ভিয়েতমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ক্রমাগত পরাজয় বরণ করতে থাকে। হ্যানয় ও হাইফংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল তাদের হাতছাড়া হয় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে। এই অবস্থায় ফরাসি সেনাপতি নেভারে ভিয়েতমিনদের করেন, যা নেভারে প্ল্যান নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা অনুসারে ফ্রান্স উত্তর ভিয়েতনামের টংকিংয়ের দিয়েন-বিয়েন-ফু নামক স্থানে একটি সশস্ত্র ঘাট নির্মাণ করে। এই খবর পেয়ে ভিয়েতমিন সেনাপতি জেনারেল নগুয়েন গিয়াপ সেই খাঁটি ধ্বংস করেন ও ১৫ হাজার ফরাসি সেনাকে বন্দী করেন। ৫৭ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ফরাসি বাহিনী আত্মসমর্পণের বাধ্য হয় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে। আট বছরব্যাপী এই যুদ্ধের জন্য ফ্রান্সকে প্রচুর মূল্য দিতে হয়। এই যুদ্ধে মোট ৯২ হাজার ফরাসি না নিহত হয় এবং প্রায় এক লক্ষ ১৪ হাজার সেনা হতে হয়।
৯. জেনেডা সম্মেলন
দিয়েন-বিয়েন-ফু র যুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয় পর বিয়েতে নামের ফ্রান্স আর যুদ্ধ চালাতে রাজি ছিল না। ফ্রান্সের নতুন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের মেন্ডেস ফ্রান্স শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে ইন্দ্রচীন সমস্যার সমাধান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে দিয়েন-বিয়েন-ফু র ঘটনার পরদিন ইন্দ্রচীন সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে জেনেভাতে এক সম্মেলন বসে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ৮ মে। এই সম্মেলনে হো-চি-মিন সরকারের সঙ্গে ফ্রান্স এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুসারে
(i) ১৭ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনাম কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। বলা হয় অক্ষরেখার উত্তরাংশে হো-চি-মিন নেতৃতাদিন বিয়ে তুমি এবং দক্ষিণাংশে ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন ন-দিন-দিয়েম এর শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
(ii) ভিয়েতনামের এই বিভাজন সম্পূর্ণ অস্থায়ী। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভিয়েতনামের সংযুক্তি উদ্দেশ্যে জাতিপুঞ্জের দ্বারা গঠিত এক তদারকি কমিশনের নেতৃত্বে দু’বছর পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে এখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
(iii) ভিয়েতনামের নির্বাচন দাদার ক্ষীর উদ্দেশ্যে ভারতের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের অপার দুই সদস্য ছিলেন পোল্যান্ড ও কানাডা।
(iv) এই চুক্তিতে আরো বলা হয় যে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সকল বিদেশি সেনা অপসারণ করা হবে।
(v) লাওস ও কম্বোডিয়া থেকে ফরাসিও ভিয়েতমিন বাহিনী সরিয়ে নেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সরাসরি অংশ নিলে ভিয়েতনাম সংকটকে গিয়ে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির সূচনা ঘটে।
মূল্যায়ন
হো-চি-মিন তার জীবদ্দশায় ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনামে স্বাধীনতার সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করে যেতে পারেননি। তবে তার অর্ধম্য প্রচেষ্টার ফল স্মৃতি হিসেবে পরবর্তীকালে এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের দিয়েম সরকারের কদম ঘটে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর। ভিয়েতনামিদের গেরিলা রণ কৌশলে বিধ্বস্ত হয়ে এবং বিশ্ব জনমতের বিরোধিতার জেরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নিলে কংরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের দখল নেয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ ভিএস নামের মিলনে আত্মপ্রকাশ ঘটে হো-চিন-মিনের স্বপ্নের সোশালিস্ট রিপাবলিক অফ ভিয়েতনামের।