ভূমিকা
মেইজি পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পর জাপান আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলি সমকক্ষ হয়ে ওঠে জাপান। পশ্চিমী শক্তিদের মতই জাপান ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে। পশ্চিম শক্তিগুলির বিরুদ্ধে জাপান আগ্রাসীন বিদেশী নীতির প্রয়োগ ঘটায়। এশিয়ায় নিজেদের একছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পশ্চিম শক্তিগুলির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে জাপান স্লোগান তুলে এশিয়াদের জন্য এশিয়া।
‘এশিয়াদের জন্য এশিয়া’- উদ্দেশ্য
জাপানের এই স্লোগানের কয়েকটি উদ্দেশ্য হলো –
১. পশ্চিমী শক্তির প্রতিরোধ
জাপান মনে করতে এশিয়ার কোনো অংশই ইউরোফি শক্তি গুলির উপনিবেশী স্থাপনের অধিকার নেই। কেবলমাত্র এশিয়ায় এশিয়ার শাসন করার অধিকার। তাই ইতিপূর্বে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত ইউরোপীয় শক্তি গুলি উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল সেগুলির অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে জাপান সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই উপনিবেশীয় শক্তিগুলির স্থলে জাপান নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।
২. জাপানি সম্প্রসারণ নীতি
এশিয়াদের জন্য এশিয়া এই স্লোগান তুলে জাপান আসলে এশিয়া জুড়ে এক গৃহ জাপানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল। বিশেষত পূর্ব এশিয়ায় জাপা নিজে সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজা বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে এক বক্তৃতায় বলেন পূর্ব এশিয়ার এশিয়া বাসীদের জন্য এশিয়া নীতির দ্বারা তাদের সম্প্রসারণের আসা প্রচারিত হয়েছে।।
৩. এশিয়া ঐক্য গঠন
এশিয়াদের জন্য এশিয়া এই স্লোগান তুলে জাপানি এশীয় শক্তিগুলিকে একজোট করতে চেয়েছিল। জাপান চেয়েছিল এশিয়ার শক্তি গুলি একজন হয়ে ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তি গুলিকে প্রতিরোধ করুক। তাই জাপান পশ্চিমে দেশগুলির বিরুদ্ধে এশিয়ার দেশগুলি যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করে। প্রশান্ত মহাসাগরের অঞ্চল নিজেদের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাপান এই অঞ্চলের রাজনৈতিক শক্তি ও জাতিগুলিকে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের শামিল করানোর প্রচেষ্টা চালায়।
৪. এশিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যাবার মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে অক্ষশক্তি জোটে যোগ দিয়েছিল। জাপান চেয়েছিল মিত্রশক্তির পক্ষ ইউরোপ ও আমেরিকার কর্তৃত্বাধীন এশীয় অঞ্চলগুলিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। পশ্চিম শক্তি গুলিকে হতিয়ে দিয়ে বৃহত্তর পূর্ব এশিয়ার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাবা নিজের একছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। জাপান চেয়েছিল এশিয়ার নেতৃত্বে ভার থাকুক তার হাতে।
৫. প্রাকৃতিক সম্পদ লাভ
আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স সহ ইউরোপীয় শক্তি গুলি পূর্বে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে একটানা প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ও কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজের দেশে নিয়ে যায়। এইভাবে ইউরোপীয় দেশ গুলি সহজে শিল্পের বিকাশ ঘটানো হয়। জাপান এটা মেনে নিতে পারিনি কারণ জাপান মনে পড়তো এশিয়া ভূখন্ডে যাবতীয় সম্পাদক কাঁচামালের ওপর অধিকার রয়েছে একমাত্র এশিয়াদের। ইউরোপীয়দের এই অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে তোলার বিরুদ্ধে জাপান সচেষ্ট হয়ে ওঠে এবং স্লোগান তোলে এশিয়দের জন্য এশিয়া।
‘এশীয়দের জন্য এশিয়া’- ব্যাখ্যা
এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে জাপা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। শুধু তাই নয় জাপান চেয়েছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলি সমকক্ষ হয়ে উঠতে। এই আকাঙ্ক্ষা চিরতর্থ্য করার লক্ষ্যে জাপান স্লোগান তুলেছিল এশিয়দের জন্য এশিয়া।
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জাপানি সাম্রাজ্যবাদ
(১) মেইজি পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পর : মেইজি পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট মুৎসুহিতো জাপানের সঙ্গে পশ্চিমে শক্তি গুলি সামাজিক সংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ফলে পশ্চিমে সভ্যতার উপকরণ দিয়ে জাপানের নতুন সাম্রাজ্যের ভিত্তি নির্মিত হয়। জাপান ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে ওঠে। জাপানের বিদেশ নীতিতে সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিরোধ করে আর্থিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রতিফলন ঘটে।
(২) সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ : ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে চীন জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। এশিয়া ভূখণ্ডে জাপান আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে চিনো জাপানের মধ্যে এই বিরোধে সূচনা ঘটে। এশিয়া ভূখণ্ডে রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে জাপান চেয়েছিল কোরিয়ানকে পরাজিত করতে। কিন্তু কোরিয়ান জাপানের হাতে চলে যাক চীন তা চাইনি। তাই চীন জাপান যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। চীন জাপানের যুদ্ধে চীনের পরাজয় ও সিমোনোসেকির সন্ধির ফলে চীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(৩) রুশো-জাপান যুদ্ধ : ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। চীনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে দখল কে কেন্দ্র করে এই দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ বাদে। এই যুদ্ধে রাশিয়ায় জাপানের কাছে পরাজিত হয়। উভয় দেশের মধ্যে স্পোটোস মাউথ সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধির স্বাক্ষরের ফলে একদিকে যেমন দূরপ্রাচ্যে রাশিয়ায় আগ্রাস ইন নীতি বাধা প্রাপ্ত হয়, অপরদিকে তেমন জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়।
(৪) জাপানি সাম্রাজ্যবাদের তীব্রতা বৃদ্ধি : রুশো জাপান যুদ্ধে জেতার পর জাপানে সাম্রাজ্যবাদী তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ইতিপূর্বে শিমোনোসেকির সন্ধি হলে জাপান ফরমজা দ্বীপের অধিকার লাভ করেছিল। পরে স্পোটস মাউথ এর সন্ধি বলে জাপান কোরিয়ান ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। রুশো জাপান যুদ্ধে পর দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া তে জাপানের প্রভাব স্বীকৃতি পায়। শিমোনোসেকির সন্ধির পর সুকৌশলে জাপান শান্টুং অঞ্চল নিজের অধিকারে আনে।
(৫) ২১ দফা দাবি : শান্টুং প্রদেশে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার পর জাপান চীনের কাছে ২১ দফার দাবি পেশ করে। পরবর্তীকালে ভার্সাই সন্ধিতে জাপানের ২১ দফা দাবি গুলির মধ্যে বেশকিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়। দূর রাজ্যে জাপান এক প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত জাপানি সাম্রাজ্যবাদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বে এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে ইউরোপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। ইউরোপীয় এই সমস্ত শক্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি দেশ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে জাপানের আত্মপ্রকাশ এই সমস্ত দেশগুলি ভীতি হয়ে পড়ে এবং তারা জাপানকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
(১) ওয়াশিংটন সম্মেলন : ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে ইঙ্গ জাপান চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু জাপান এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তাই মার্কিন উদ্যোগে আয়োজিত হয় ওয়াশিংটন সম্মেলনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে। এই সম্মেলনের মধ্যে জাপানের সামরিক শক্তি হ্রাস ও সাম্রাজ্যবাদী নদীতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাই ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেন, “ওয়াশিংটন চুক্তির ফলে জাপানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও এশিয়া ভূখণ্ডের ওপর সম্প্রসারণ নীতির প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল।”
(২) জাপানের মাঞ্চুরিয়া অধিকার : জাপান নিজে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নির্দেশন হিসেবে চীনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলটি অধিকার করে নেয় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। সোভিয়েত রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলি জাপানের সমালোচনা করে। রাষ্ট্রসংঘ ও লিটন কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জাপানের মানসুরিয়া অধিগ্রহণকে সমালোচনা করে।
(৩) জাপানের মনরো নীতি : মাঞ্চুরিয়া অধিকার করার পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভূমিকায় জাপান ক্ষুব্ধ হয়। প্রতিবাদ হিসেবে জাপান রাষ্ট্রসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। পূর্ব এশিয়াতে জাপান নিজের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এক নতুন নীতি গ্রহণ করে। এই নীতির নাম জাপানি মনরো ডকট্রিন ফর ইস্ট এশিয়া। সেই নিতে ঘোষণা করে জাপান হুশিয়ারি দিয়ে বলে পাশ্চাত্য শক্তি পরপর যেন পূর্ব এশিয়াতে কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। জাপানি নীতির দ্বারা দেখালে যে ছিল যে চীনকে প্রাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের কমল থেকে রক্ষা করতে জাপান উৎসাহী। কিন্তু জাপানের আসল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব এশিয়াতে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা।
(৪) পূর্ব এশিয়ার নতুন বিধান : জাপানের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব এশিয়ায় নতুন বিধান ঘোষণা করেন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। এই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ প্রবর্তন করা। জাপানের এই উদ্যোগে শঙ্কিত হয়ে প্রাশ্চাত্য শক্তিবর্গ চীনের পাশে দাঁড়ায়।
(৫) ইন্দ্রোচিন দখল : রাস্তা তো সত্যি বর্গের প্রতি রোদে আগ্রহ করে জাপান ইন্দ্রো চীনের দখল নেয়। এই প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যাবতীয় রপ্তানি সামগ্রিক বন্ধ করে দেয়। ফলে জাপান মার্কিন সম্পর্ক তিক্ততায় পরিণত হয়।
(৬) প্রশান্ত মহাসাগরীর যুদ্ধ : জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি পার্ল হারবারের বোমা নিক্ষেপ করে মার্কিন বিরোধী অক্ষশক্তি জোটে যোগ দেয়। জাপানের সামরিক বাহিনী প্রথম দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দ্র বর্মা সীমান্ত, অ্যালিসিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, সোলেমনস, নিউ গিনি প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে নেয়। পরে অবশ্য জাপান প্রশান্ত মহাসাগরের মিডওয়ে দ্বীপের যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনাবিক বোমা নিক্ষেপ করলে জাপান আত্মসমর্পণ করে।
মন্তব্য
‘এশীয়দের জন্য এশিয়া’- এই স্লোগান তুলে জাপান আসলে নিজের সাম্রাজ্যবাদী আশঙ্কাকেই চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই উক্তির বাস্তব রূপায়ণ ঘটাতে গিয়ে জাপান বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরিণতি হিসেবে শেষ পর্যন্ত জাপানি সাম্রাজ্যবাদেরই অবসান ঘটবে।