ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ওপর আলোকপাত করো?

সূচনা

ভারত ছাড়ো আন্দোলন, নৌ বিদ্রোহ, আজাদ হিন্দ ফৌজ এর বিচার ও ছাত্র আন্দোলন, একাধিক শ্রমিক ধর্মঘট, বাংলার তেভেগা কৃষি আন্দোলন, ত্রিবাঙ্কুরের পূন্নাপ্রা-ভায়লারের গণ সংগ্রাম, তেলেঙ্গানায় কৃষি বিদ্রোহ এবং দেশীয় রাজ্যগুলিতে তীব্র প্রজা আন্দোলন জাতীয় রাজনীতিকে উত্তাল করে তোলে। দেশব্যাপী এই সমস্ত একাধিক গণ আন্দোলনের যেড়ে ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ সহ জাতীয় দল গুলির ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে সরব হয়। মমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ একাধিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের প্রতি কংগ্রেস ও লীগের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের উদ্যোগ ও অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতীয়দের অংশগ্রহণ

১. ওয়াভেল পরিকল্পনা ও সিমলা বৈঠকের ক্ষেত্রে

(১) ভারতীয়দের প্রতি প্রস্তাব : জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতভেদের কারণে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। এই অচলা বস্তার অবসানের জন্য বড়লাট ওয়াভেল ব্রিটিশ মন্ত্রী সভার সঙ্গে আলোচনা করে একটি পরিকল্পনা পেশ করে। এই পরিকল্পনা কিছু প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাবগুলি আলোচনা করার জন্য বড়লাট ওয়াভেল সিমনাথের সর্বদলীয় নেতাদের একটি বৈঠক ডাকেন ২৫ জুন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। এই উদ্দেশ্যে ১৫ জুন কংগ্রেস কার্য নির্বাহক সমিতির বন্দি সদস্যদের মুক্তি দেন। কংগ্রেসের পক্ষে মৌলানা আসাদ ও মুসলিম লীগের পক্ষে জিন্না এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও এই বৈঠকের শিখ ও তপশিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা যোগ দেন।

(১) ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া : (i) মুসলিম লীগ : মুসলিম লীগের তরফে জিন্যাস সিমলা প্রস্তাব সমর্থনে জন্য দুটি শর্ত আরোপ করেন।

প্রথমত, তিনি বলেন বড়লাটের শাসন পরিষদের প্রস্তাবিত পাঁচ জন মুসলমান সদস্য এর প্রত্যেককেই মুসলিম লীগভুক্ত হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বড়লাটের ভোট দানের অধিকারের মধ্যে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়াও তিনি বলেন বড়লাটের শাসন পরিষদের কোন প্রস্তাব মসলিমদের মনঃপূত না হলে সে প্রস্তাবটি দুই তৃতীয়াংশ সদস্য বড়লাটের স্বার্থ পরিষদ দ্বারা অনুমোদন করাতে হবে।

(ii) কংগ্রেস : জাতীয় কংগ্রেস জেনার দাবি আগ্রহ করে। কংগ্রেসের তরফ থেকে বলা হয় যেহেতু কংগ্রেস বহু জাতীয়তাবাদী মুসলমান সদস্য রয়েছে তাই বড়লাটের শাসন পরিষদ মুসলমান সদস্যদের মনোনয়ন করবে কংগ্রেস। বড়লাটের শাসন পরিষদের সদস্য কারা হবেন সে বিষয়ে কংগ্রেস বড়লাটকে এক তালিকা পাঠায়। সেই তালিকা তে ছিল দুজন হিন্দু, একজন মুসলমান, একজন পারসি ও একজন খ্রিস্টান।

(iii) শিখ ও সংখ্যালঘুদের পক্ষে : শিখ নেতা তারা সিং ও সংখ্যালঘু নেতা শিবরাজ কংগ্রেস মুসলিম লীগের প্রাধান্যে বিরোধিতা করেন। তারা নিজেও নিজে নিজে সদস্যদের বড়লাটের শাসন পরিষদে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে সরব হন। এছাড়াও পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট দলের নেতা খিরিজ হায়াৎ খাঁ এবং বাংলার কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক প্রমুখ ও মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেন।

২. মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন

(১) ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর ভারতের উত্তল গণ আন্দোলন ও গণ বিক্ষোভ থেকে ব্রিটিশ অনুভব করে যে এবার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রয়োজন। এই অনুভব থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলি ঘোষণা করেন, ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ক আলোচনার জন্য ক্যাবিনেট মিশন পাঠানো হবে। ঘোষণা মত ক্যাবিনেট এ মিশন ভারতে আসে ২৪ মার্চ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। মিশনে সদস্যরা ভারতের বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে ১৮২ টি বৈঠক করে। এছাড়াও এই মিশনে সদস্যরা ৪৭২ জন জাতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনা চালান। মন্ত্রী মিশন তার পরিকল্পনায় বেশ কিছু সুপারিশ উল্লেখ করে।

(২) প্রতিক্রিয়া : (i) কংগ্রেস : মন্ত্রী মিশনে পরিকল্পনায় পাকিস্তানের উল্লেখ না থাকায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়নি। কিন্তু অন্তবর্তী সরকারে কংগ্রেস ও লিখে সমমর্যাদা দেওয়ায় কংগ্রেস ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়াও গণপরিষদের প্রকৃত ক্ষমতা কেমন হবে তা নিয়ে কংগ্রেস সন্দেহ প্রকাশ করে। (ii) মুসলিম লীগের : মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রদেশ গুলি কে ভাগ করার কথা বলা হয়। এই প্রাদেশিক বিভাজন নীতি পাকিস্তানের গঠনের উপযোগী হবে মনে করে মুসলিম লীগ একে স্বাগত জানায়। জিন্না বলেন -“সংখ্যালঘু সমস্যার এর চেয়ে ভালো সমাধান আশা করা যায় না।”

২. অন্তবর্তী কালীন সরকার

মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন ভারতে এসে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রচেষ্টা শুরু করে। মিশন তার সাংবিধানিক প্রস্তাবগুলি ছাড়াও আরো দুটি প্রস্তাব রাখে। এর মধ্যে একটি ছিল অন্তবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং অপরটি ছিল সংবিধান সভা গঠন।

(১) সরকারে কংগ্রেসের অংশগ্রহণ : জহরলালের নেতৃত্বে কেন্দ্রে অন্তবর্তী সরকার গঠিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর। এই সরকার উপ সভাপতি বা প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নিজে। মন্ত্রি সবাই ১২ জন সদস্যদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন কংগ্রেসের।

(২) মুসলিম লীগের ভূমিকা : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কংগ্রেসের একক ক্ষমতা বৃদ্ধির লীগ ভালোভাবে নেয়নি। তবুও বড়লাট ওয়াভেল অনুরোধে লীগের পাঁচ জন সদস্য মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়। মন্ত্রী সবাই যোগ দিলেও লীগের মন্ত্রীরা একটি পৃথক গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতো। তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল সরকারি কাজে নানা ভাবে বাধা সৃষ্টি করা এবং এর দ্বারা সরকারকে অচল করে ভারতে বিভাগকে অনিবার্য করে তোলা। মন্ত্রী পরিষদ যোগদানের উদ্দেশ্যে সম্পর্কে লিয়াকৎ আলী খাঁ বলেন -“আমাদের সযত্ন লালিত বাসনা পাকিস্তান অর্জনের লড়াইয়ের এই শক্ত ভিত্তি ভূমির লক্ষ্মী আম্মারা অন্তর্বর্তী সরকারের যোগ দিচ্ছি।

৪. মাউন্টব্যাটন পরিকল্পনা

(১) দেশ ভাগের ঘোষণা : মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জেরে দেশ জুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ব্রিটিশ উদবিগ্ন ও শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ভারতীয়দের হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে এদেশে গর্ভনর হিসেবে আসেন মাউন্টব্যাটন। মাউন্টব্যাটন তার পরিকল্পনা দেশভাগের কথা ঘোষণা করেন।

(২) প্রতিক্রিয়া : (i) কংগ্রেসের : মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা দেশ বিভাগের উল্লেখ্য থাকায় গান্ধীজী এবং মৌলোনা আবুল কালাম আজাদের বিরোধিতা করে। আজাদ বলেন -“দেশভাগ হল এক দৈব দুর্বিপাক।” বল্লভ ভাই প্যাটেল অবশ্য অন্য সুরে বলেন -“দেশ বিভাগ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।” ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন -“গৃহযুদ্ধের থেকে দেশভাগ ভালো।” জহরলাল নেহেরু এক বেতার ভাষনে বলেন -“আমি প্রস্তাব ভারত ব্যবচ্ছেদ হৃদয়ে কোন আনন্দসহ গ্রহণ করছি না। যদিও আমার মনে কোন সংশয় নেই যে, এটি হল শ্রেষ্ঠ বিকল্প।

(ii) মুসলিম লীগের : মুসলিম লীগের মাউন্টব্যাটন প্রস্তাবিত দেশভাগের ঘোষণা কে স্বাগত জানায়। মাউন্টব্যাটনে লীগ নেতাদের জানান অখণ্ড পাকিস্তান দেওয়া সম্ভব নয়। দ্বিখন্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাবকে পাকিস্তান ভুক্ত করা হবে। দেশভাগের সিদ্ধান্তে খুশি হলেও তাই জিন্না মাউন্টব্যাটনে ঘোষিত পাকিস্তানি বিকলাঙ্গ ও কিট দগ্ধ আখ্যা দেন। (iii) কমিউনিস্ট দল : কমিউনিস্ট দল ভারত ও পাকিস্তান দুই আলাদা রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতা করে।

উপসংহার

শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে উপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে ভারত মুক্ত হলো বটে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে অখন্ড ভারত দু টুকরো হলো। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে ভারতবাসী নৃশংস ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার মুখোমুখি হলো। লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের দেশান্তর দুই দেশের উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি হলো।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment