সূচনা
ভারতের মুদ্রা ও অর্থ বিভাগের উদ্যোগে রিয়েল কমিশন গঠিত হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মিত্র পক্ষের অন্যতম সদস্য সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন এই যুদ্ধে ভারতবর্ষকে জড়িয়ে নেয়। যুদ্ধে ভারতের বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ ব্যয় করা হলে যুদ্ধের পর ভারতের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে সরকার ভারতের অর্থনৈতিক নীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটাতে এবং মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে বাধ্য হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতে অন্তত ১২৭ মিলিয়ন পাউন্ড অর্থ এই যুদ্ধে ব্যায়িত হয়। সামরিক খাতে ভারতের ব্যয় বৃদ্ধি পায় অন্তত ৩০০ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে সংকট দেখা দেয় তার ফলে ভারতের ব্রিটিশ সরকার এ দেশের মুদ্রা ব্যবস্থা কিছু কিছু নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠা করে, যেমন-
১. মুদ্রা সংকট
ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। তারা ভারতীয় অর্থ সম্পাদক যুদ্ধের ব্যাপক পরিমাণে কাজে লাগায়। ভারতের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক পরিস্থিতির ফিরিয়ে আনার জন্য বৃটেন থেকে ভারতের বিপুল পরিমাণ অর্থ আমদানির প্রয়োজন ছিল। ইংল্যান্ডের স্বর্ণের রপ্তানির উপর নানা বিধি নিষেধ থাকায় যে পরিমাণ সোনা ভারতের প্রাপ্য ছিল ব্রিটেন তা ভারতের পাঠায়নি। একদিকে মুদ্রা তৈরির জন্য রুপোর চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এ সময় ভারতের উপর যোগান হ্রাস পায়। ফলের মুদ্রা উৎপাদন ব্যাহত হয়। এভাবে যুদ্ধের কারণে ভারতের মুদ্রা ব্যবস্থা সংকট দেখা দেয়।
২. রুপোর মূল্যবৃদ্ধি
মুদ্রা তৈরির জন্য যুদ্ধের পর রুপোর চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেলে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে রুপোর মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের বাজারে এক আউন্স রুপোর দাম ছিল ২৫-২৭ পেন্স। এই নামে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে ৫৮ পেন্স ছাড়িয়ে যায়। ভারত সরকারকে মুদ্রা তৈরির জন্য ১৯১৬ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ রুপোর উচ্চমূল্যে ক্রয় করতে হয়।
৩. রুপোর মুদ্রা তৈরিতে লোকসান
রুপোর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলের উপর মুদ্রার বাহিক্য মূল্য রুপোর মুদ্রার ধাতুর মূল্যের চেয়ে কমে যায়। হঠাৎ টাকা গলিয়ে রুপো বিক্রি করলে রুপোর টাকার বাহিক্য মূল্যের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়। ফলের উপর টাকা তৈরি করলে সরকারের লোকসান হয়। দেশের এই অর্থনৈতিক সংখ্যার দূর করার উদ্দেশ্যে সরকার ভারতীয়দের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়। শিল্প ও বাণিজ্যের উপরেও করের বোঝা যথেষ্ট পরিমাণ বাড়ানো হয়। সর্বাধিক বোঝা চাপানো হয় আয়করের ওপর। ১৯১৯-কুড়ি খ্রিস্টাব্দে সরকারি আইয়ের ১১. ৭৫ শতাংশই সংগ্রহ করা হয়েছিল আয়করের থেকে।
৪. বাণিজ্যের মন্দা
যুদ্ধে পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দিলে সারা পৃথিবীতেই দাম স্তর নেমে যায়। এই মন্দার ফলে ভারতীয় রপ্তানির মূল্য হ্রাস পায়। রপ্তানির মূল্য যেখানে ১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৩৩০ কোটি টাকা, সেখানে ১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে এই মূল্য কমে দাঁড়ায় ২৫৮ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে।
মুদ্রা সংকট দূরীকরণে পদক্ষেপ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের উপর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং এর ফলে দেশের মুদ্রা ব্যবস্থা যে সংকর দেখা দেয় তা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এগুলি হল-
(১) ভারত থেকে রুপোর মুদ্রা ও রুপোর রপ্তানি নিষেধ করা হয়।
(২) রুপোর মুদ্রা গলিয়ে মূল্যবান ধাতু হিসেবে রূপ ও বিক্রি করা বেআইনি বলে ঘোষিত হয়।
(৩) কয়েক ধরনের কাগজের মুদ্রা চালু করা হয় এবং কাগজের মুদ্রার প্রচলন বাড়ানো হয়।
(৪) মুদ্রা তৈরির ক্ষেত্রে রুপোর ব্যবহার কমিয়ে নিকেলের খুচরো পয়সা চালু করা হয়।
(৫) আমেরিকা ও কানাডা থেকে সোনা কিনে এনে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ মুদ্রা তৈরি করে মুদ্রা চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয়।
(৬) রিজার্ভ-বিহীন নোট চালুর ঊর্ধ্বসীমা ১৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২০ কোটি টাকা করা হয়।
ব্যাবিংটন স্মিথ কমিটি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের মুদ্রা ব্যবস্থায় যে সংকট দেখা দেয়, তা দূর করার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের স্যার ব্যবিংটন স্মিথের সভাপতিত্বে ‘ব্যাবিংটন স্মিথ কমিটি’ নামে এক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির মুদ্রা ব্যবস্থায় অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার উদ্দেশ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যেমন-
১. কমিটির সুপারিশ
মুদ্রা সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে ব্যাবিংটন স্মিথ কমিটির সুপারিশ করে যে-
(১) টাকাকে স্টার্লিং এর সঙ্গে যুক্ত না করে সরাসরি সোনার সঙ্গে যুক্ত করা হোক।।
(২) টাকাকে ২ সিলিং মূল্যের সোনার সমান মূল্য বলে ধরে নেয়া হোক।
(৩) ব্রিটিশ স্বর্ণমুদ্রাকে ১০ টাকার সমান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হোক।
(৪) সোনা আমদানি ও রপ্তানির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হোক।
(৫) স্বর্ণ মুদ্রা তৈরির জন্য বোম্বাইতে টাকশাল তৈরি করা হোক।
২. পরবর্তী পদক্ষেপ
যুদ্ধের প্রভাবে ভারতের অর্থনৈতিক বাজারে চরম অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। ব্যবিংটন স্মিথ কমিটির সুপারিশ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে। এই পরিস্থিতিতে সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রার সরবরাহ সংকোচ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। উনিশশো কুড়ি খ্রিস্টাব্দে থেকে 1923 খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত মুদ্রা সংকোচ নীতি গ্রহণ করা হয়।
উপসংহার
অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন। তবে এই পরিবর্তন ভারতীয়দের স্বার্থে নয়, ইংল্যান্ড নিজেদের স্বার্থে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মুদ্রা সংকট একসময় হ্রাস পেলে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের নীতি আবার একই ভাবে ভারতে মুদ্রা ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে।