ভারত বিভাজন ও শাসন নীতির প্রেক্ষাপট আলোচনা করো?

ভূমিকা

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মুসলিম উভয়ের সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহের শামিল হয়ে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এরপর থেকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারি বিদেশ বিরোধী আন্দোলন দুর্বল করার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ নীতি প্রয়োগ করে সরকার বিভাজন ও শাসন নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে পরবর্তীকালে হিন্দু মুসলিম অনৈক্য বৃদ্ধি পায় এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

বিভাজন ও শাসন নীতির প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বিভাজন ও শাসন নীতির গ্রহণ করলেও এই নীতি ব্যাপকভাবে কার্যকরী হয় বিংশ শতক থেকে। ভারতে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বিভাজন ও শাসন নীতির প্রয়োগে প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ –

১. জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তি

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দলে শক্তি ও জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং কংগ্রেসের জাতির আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকে। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ-বৃদ্ধি করে সরকার ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। বিলেতে সরকার ভারতের জাতি, ধর্ম ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতি সুযোগ কাজে লাগানো সিদ্ধান্ত নেই।

২. আলিগড় আন্দোলনের সূচনা

ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে মুসলিম নেতা স্যার সৈয়দ আহমদের ১৮১৭-১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে নেতৃত্বের উত্তর প্রদেশের আলিগড় আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ঘটে। স্যার সৈয়দ আহমদ বলে যে হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। তাদের মধ্যে ঐক্য সম্ভব নয়। তিনি জাতীয় কংগ্রেসকে একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান বলে অভিহিত করে মুসলিম সম্প্রদায়কে কংগ্রেস থেকে দূরে থাকতে বলেন। ব্রিটিশ সরকার আলিগড় আন্দোলন কে পরোক্ষ সমর্থন করে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে উস্কানি দেয়।

৩. আন্দোলন দমন

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড কার্জন স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, “যতদিন আমরা ভারত শাসন করব ততদিন পর্যন্ত আমরা হলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি।” ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার ভারতের নিজেদের শাসন নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করা এবং শ্বেতাঙ্গ জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমন করার পরিকল্পনা করে। সরকার মনে করে যে আন্দোলন দমন ও দুর্বল করার একটি অন্যতম উপায় হলো হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য বৃদ্ধি করা। সরকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই বিভেদ কাজে লাগে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে।

৪. ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের গতিরোধ

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের রাষ্ট্রীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় সচেতনার অগ্রভাগে অবস্থান করত। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সর্বাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য ছিল হিন্দু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও চিন্তাধারার অগ্রগতি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারতের মুসলিম ও অন্যান্য আব্রান্মণ সম্প্রদায় গুলিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করে। সরকার ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টিতে পরখ উৎসাহ দেয়। কিভাবে সরকার হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে এমন কে বর্ণ হিন্দু ও পিছিয়ে পড়া হিন্দুদের মধ্যে বিরোধী করলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা চালায়।

উপসংহার

ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ এর মতে, “জনগণকে বিভিন্ন সম্প্রদায় গোষ্ঠীতে বিভক্ত করার যে নীতি মর্লে মিন্টো সংস্কারের দ্বারা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা মন্টেগু-চেমসর্ফোড সংস্কার আরও প্রসারিত হয়েছিল।” এতে নির্বাচকমণ্ডলীকে অন্তত দশটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তার ১০ থেকে বেড়ে ১৭ হয়েছিল এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে আরো দুর্বল করার উদ্দেশ্যে তপশিলি জাতিকে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। পন্ডিত লালা বাহাদুর শাস্ত্রী সরকারের এই বিভেদ নীতি কে ভারতের জাতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি নির্লজ্জ ঘটনা বলে অবহিত করেছেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মি. বি. এন. নারায়ণ মন্তব্য করেছেন যে, “তখন বৈচিত্র, দ্বন্দ্ব ও সমস্যার জর্জরিত ভারতবর্ষে ছিল শাসনের অযোগ্য।”

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment