‘বিভাজন ও শাসন নীতি’
শুভ প্রাচীন কাল থেকে ভারতে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রতি বজায় থাকলেও ব্রিটিশ শাসনকালে সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চিরতার্থ করার উদ্দেশ্যে সুকৌশলে এই সম্প্রতি ধ্বংস করে এবং হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তোলে। মূলত ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দুর্বল করে এদেশে ব্রিটিশ শাসক কে নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারতের জাতি, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতির মধ্যে বিভেদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। স্যার জন স্ট্রাচে এক সময় লেখেন যে, “ভারতে পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী অস্তিত্ব আমাদের পক্ষে একটি দারুন সুবিধা।”সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের এক জাতির বিরুদ্ধে অন্য জাতিকে এবং এক ধর্মের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। ভারতের ব্রিটিশদের এই শাসন পদ্ধতি বিভাজন ও শাসন নীতি নামে পরিচিত।
সম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধির কারণ
উনবিংশ শতকে প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হিন্দু, মুসলিম অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বিশেষ প্রকট ছিল না। সরকার ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদৃষ্টির চেষ্টা চালায়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। সরকার এই উদ্যোগের বিভিন্ন কারণ ছিল, যেমন –
১. এলফিনস্টোনের ভূমিকা
বোম্বাই ব্রিটিশ গর্ভনর ফিলফিনস্টোন ১৮১৯-১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারকে বোঝানোর জন্য প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের অনুসৃত বিভাজন ও শাসন নীতি প্রয়োগ করা দরকার। তার মতামত সরকারকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
২. মহাবিদ্রোহে হিন্দু মুসলিম ঐক্য
হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে মহাবিদ্রোহের ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ব্রিটিশ সরকার এর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তার বিদ্রোহ দমনে সরকার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে শাস্তি দেয়। এই উদ্দেশ্যে শুধু দিল্লিতে ২৭ হাজার মুসলমানকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই সময় থেকে সরকার হিন্দু মুসলিম ঐক্য ধ্বংস করার প্রয়োজন বোধ করে।
৩. আলীগড় আন্দোলনের ভূমিকা
কোন শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ সৈয়দ আহমদের ১৮১৭-১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে উদ্যোগে আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ঘটে। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলনের মাধ্যমে সৈয়দ আহমদ ভারতের দ্বিজাতি তত্ত্বের সূত্রপাত ঘটান। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেন যে, হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সামিল হয়ে এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে আলীগড় আন্দোলনের নেতারা হিন্দু ও কংগ্রেসের বিরোধী হয়ে উঠলে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ সুবিধা হয়।
সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির প্রসার
ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর থেকে শুরু করে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতি প্রয়োগ করে। আর যদি ৭০ এর দশক থেকে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সম্ভাবনা দূর করতে সরকার মুসলিম সম্প্রদায়কে তোষণ করে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেই। এই সময় কাল সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত বিভেদ নীতিকে তিনটি পর্যায় বিভক্ত করা যায়। যথা-
১. প্রথম পর্যায়
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মোটামুটি ভাবে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সরকার কর্তৃক গৃহীত সম্প্রদায়ক বিবেক নীতি প্রথম পর্যায়ে ভুক্ত করা হয়। জন লরেন্স ১৮৬৪-৬৯ খ্রিস্টাব্দে এদেশে সর্বপ্রথম পাঞ্জাবের সেনাবাহিনীতে বিভাজন ও শাসন নীতি কার্যকর করেন। এই পর্বের ব্রিটিশ বিভেদ নীতি হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থে এবং মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হতো। ব্রিটিশরা প্রথমে মুসলিমদের আধিপত্য ধ্বংস করে ভারতে সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটিয়েছিল। প্রথম দিকে ব্রিটিশ শাসনের নিম্ন স্তরের বিভিন্ন পদে কাজের জন্য শিক্ষিত হিন্দি ব্রাহ্মণরা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবে এই পর্যায়ে ব্রিটিশরা হিন্দুদের প্রতি সদাই ছিল। এই সময় হিন্দুদের প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করা হয়। তখন লর্ড এলেনবরা বলেন যে, “মুসলিম জনসমাজ মৌলিকভাবে আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, তাই আমাদের আসল লক্ষ্য হবে হিন্দুদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো।”
২. দ্বিতীয় পর্ব
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ব্রিটিশ সরকারের বিবেক নীতি প্রকৃতি বদলাতে থাকে। সরকার হিন্দু দর্শন এর পরিবর্তে মুসলিমদের তোষণের নীতি গ্রহণ করে। স্যার উইলিয়াম লি নামে জৈন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্তা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্য করেন যে, ১৮৬৯ থেকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময় শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের ব্রাহ্মণের আধিপত্য অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময় ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তার ‘দা ইন্ডিয়ান মুসলমাস’ ১৮৬৯-১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারতকে দার-উল-হারব বা শত্রুর দেশ বলে প্রচারে উস্কানি দেন। লর্ড রিপন এক আইন প্রণয়নের ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন এবং স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসনের মুসলিমদের আরও বেশি করে সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেন। লট ডাফরিন মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে বলেন যে পাঁচ কোটি মানুষ মুসলিমরা নিজেরা একটি জাতি, খুব শক্তিশালী একটি জাতি।
৩. তৃতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্যায় বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সরকার উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া হিন্দু অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিকে তোর্ষণ করতে শুরু করে।
উপসংহার
লর্ড কার্জনের আমলে সরকারের সম্প্রদায়িক বিভেদ তীব্র আকার ধারণ করে। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে হলে সরকার বিভাগ নীতি প্রয়োগ করে বারংবার মুসলিম লীগ তথা মুসলিমদের সম্প্রদায়কে তোষণ করে হিন্দু মুসলিম বিবেক বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালায়। এর দ্বারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে যথেষ্ট দুর্বল করতে সরকার বেশ কয়েকবার সফল হয়।