১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু-চেমফোর্ড সংস্কার আইনের বিভিন্ন শর্ত গুলি উল্লেখ করো?

মন্টেগু-চেমফোর্ড আইনের শর্তাবলী

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত মর্লে মিন্টো শাসন সংস্কার ভারতীয়দের ক্ষোভ প্রশমন করতে পারেনি। এর এক দর্শক পরে ভারত সচিব মন্টেগু ও ভাইসরয় লর্ড চেমফোর্ডের যৌথ রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন ভারত শাসন আইন পাস হয়। এটি মন্টেগু-চেমফোর্ড শাসন সংস্কার বা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন নামে পরিচিত। এই আইনের প্রধান শর্তাবলী ছিল নিম্নরূপ-

১. ক্ষমতা বন্টন

মন্টেগু-চেমফোর্ড আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্ট ভাবে বন্টিত হয়।

(১) কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা : কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশ রক্ষা, রেল ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা, বৈদেশিক সম্পর্ক, আয়কর, শুল্ক, বাণিজ্য ও ডাক ব্যবস্থা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি দায়িত্ব দেওয়া হয়।

(২) প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা : প্রাদেশিক সরকার গুলির হাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, ভূমি রাজস্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২. কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ

মন্টেগু-চেমফোর্ড আইনের দ্বারা সাত জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ বা বড়লাটের শাসন পরিষদ গঠিত হয়। এই সাতজনের মধ্যে অন্তত তিনজন সদস্য হবেন ভারতীয়। এই শাসন পরিষদের সহায়তায় বড়লাট শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পান। বড়লার তার কার্যাবলী জন্য ভারতীয় আইনসভার কাছে নয়, ভারত-সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতেন।

৩. কেন্দ্রীয় আইনসভা

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমফোর্ড সংস্কার আইন দ্বারা কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠন করা হয়। এ বিষয়ে দিকগুলি ছিল-

(১) দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা : মন্টেগু-চেমফোর্ড আইন দ্বারা কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এ নিম্ন কক্ষের নাম হয় কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং উচ্চকক্ষের নাম হয় রাষ্ট্রীয় পরিষদ।

(২) সদস্য সংখ্যা : উচ্চ কক্ষের ৬০ জন সদস্যদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন বড়লাটের দ্বারা মনোনীত ও ৩৪ জন কে নির্বাচিত এবং নিম্ন কক্ষের ১৪০ পরে ১৩৫ জন সদস্যদের মধ্যে ৪০ জনকে মনোনীত এবং ১০০ পরে ১০৫ জনকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়। উভয়পক্ষে সম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

(৩) আইন প্রণয়ন : আইনসভার সদস্যরা সভায় কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন, বিতর্কে যোগদান, ছাঁটাই বা সংশোধন প্রস্তাবের প্রভৃতি অধিকার পেলে ও বৈদেশিক নীতি, সামরিক বিভাগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড়লাটের পূর্ব অনুমতি ছাড়া আলোচনার অধিকার পেতেন না। বড়লাট বা আইনসভার যে কোন আইন সংশোধন বা বাতিল করতে পারতেন। তিনি নিজেও অ্যার্ডিন্যান্স জারি করে আইন প্রণয়ন করতে পারতেন।

৪. প্রাদেশিক দ্বৈত শাসন

মন্টেগু-চেমফোর্ড আইন দ্বারা প্রদেশ গুলিতে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এর সত্যর শতাংশ সদস্য নির্বাচিত ও ৩০ শতাংশ সদস্য গর্ভনরের দ্বারা মনোনীত করার ব্যবস্থা হয়। রাধেশ্যক সরকারের দায়িত্ববলীগের দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা সংরক্ষিত বিষয়ে এবং হস্তান্তরিত বিষয়। সংরক্ষিত বিষয় ছিল আইনশৃঙ্খলা, অর্থ, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার‌ ও স্রম প্রভৃতি। প্রাদেশিক গর্ভনর ও তার কার্য নির্বাহক সভার ওপর এই বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

হস্তান্তরিত বিষয়গুলি ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বয়ত্বশাসন প্রভৃতি। এই বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে। মন্ত্রা তাদের কাজকর্মের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। হস্তান্তরিত বিষয়ে প্রাদেশিক আইনসভার দ্বারা পাশ করা কোন আইন গর্ভনর বা গর্ভনর জেনারেল বাতিল করতে পারতেন। এভাবে এই আইনের মাধ্যমে প্রদেশ গুলিতে একদিকে গর্ভনরের কার্যনির বাহক সভা এবং অন্যদিকে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার দৈত্য শাসন ব্যবস্থা চালু হয়।

৫. ভারত সচিবের কাউন্সিল

মন্টেগু-চেমফোর্ড আইনে বলা হয় যে ভারতের সচিবের কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা ৮ থেকে ১২ জন হবে। এর অর্ধেক সদস্য নিযুক্ত হবেন ভারতে কমপক্ষে ১০ বছর বসবাস বা চাকরি করছেন এমন ব্যক্তির মধ্যে থেকে। এই সদস্যদের বেতন ও ভাতা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ সরকারের হাতে।

উপসংহার

শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্কের যে ব্যবধান থাকে তা এই আইনের গুরুত্ব উপলব্ধি থেকে বাধার সৃষ্টি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাতীয় চেতনার উদ্বুদ্ধ ভারতীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আরো বেশি সচেতন হয়ে ওঠে। তাই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে আইন তাদের খুশি করতে পারেনি। তারা চাইছিল আরো দ্রুত এবং আরও বেশি রাজনৈতিক অধিকার। তাই ডক্টর মেহরোত্রা মনে করেন যে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ মন্টেগু-চেমফোর্ড আইনের সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেননি। বাস্তব ক্ষেত্রে এই আইন ছিল ভারতীয়দের অধিকার দানের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment