ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ভারতীয় সমাজের কিরূপ প্রভাব ফেলেছিল?

ভারতীয় সমাজের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব

অষ্টাদশ ও নবীর শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের যে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে তা ভারতের সমাজ জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আন্দোলনের প্রভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সমাজে বহু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-

১. সামাজিক কুসংস্কার হ্রাস

উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে বহু সামাজিক কুসংস্কার দুর্বল হতে শুরু করে। আন্দোলনের চাপে কুসংস্কার আঁকড়ে থাকার রাধাকান্তদের, রাম কমল সেন প্রমুখ রক্ষণশীলদের সামাজিক প্রভাব যথেষ্ট খর্ব হয়। ফলে সামাজিক অন্ধবিশ্বাস, অনুষ্ঠান সর্বস্বতা, কুসংস্কারের বাঁধন ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। ভারতীয় সমাজ হীনম্মন্যতা নতুন আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে ওঠে।

২. প্রাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ

বিভিন্ন সংস্কারকে উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিষয় ভারতীয়দের গোড়ামী অনেকটাই দূর হয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি ও আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের পথ সুগম হয়। আলীগড় আন্দোলনের প্রভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মোদী ও পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সরকার ও প্রয়োজনে তাগিদে পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে থাকে।

৩. সংস্কৃতি অগ্রগতি

সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ভারতীয় সমাজে সংস্কৃতি ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটায়। বিভিন্ন সংস্কারের আন্দোলনে ভারতীয় সমাজে রাষ্ট্রের ভাবধারায় অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য দর্শন আধুনিকতা, যুক্তিবাদ, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, বিজ্ঞান সচেতনতা প্রভৃতি প্রসার ঘটে। ধর্মীয় কুসংস্কার দুর্বল হয়ে প্রগতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। রাজ্জাকের সংস্কৃত ও বৌদ্ধিক চেতনার প্রভাবে ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অগ্রগতি ঘটে।

৪. জাতীয়তাবাদের বিকাশ

সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার ছড়িয়ে পড়লে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় ভাবধারায় দীক্ষিত এই প্রগতিশীল শ্রেণীর চিন্তা চেতনা থেকে ভারতের জাতীয়বাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। জাতীয়তাবাদী চিন্তা ধারায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে শুরু করে। তারা সরকারের কাছে ভারতীয়দের বিভিন্ন অধিকারের দাবি তুলে ধরে। জাতীয় চেতনার বিকাশের ফলে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।

৫. নারী কল্যাণ

সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ভারতের চিরনির্যাতিত নারী জাতির প্রতি সহানুভূতির বার্তা বরণ তৈরি হয়। পুরুষের বহুবিবাহ, কন্যা সন্তান হত্যা, নারীদের বাল্যবিবাহ, সীতাদাহপ্রথা, পর্দা প্রথা, পণপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সমাজের মানুষ ক্রমে সচেতন হয়ে ওঠে। নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটলে সমাজের সার্বিক উন্নতি ঘটে।

উপসংহার

আচার্য যদুনাথ সরকার মনে করেন যে, ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে পরবর্তীকালে ভারতের নবজাগরণ সংঘটিত হয়। এই নবজাগরণ সংগঠনের ক্ষেত্রে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বস্তুতপক্ষে, ইতালি নবজাগরণের জ্ঞানীগুণী পন্ডিতরা যতটা ভূমিকা নিয়েছিল ভারতীয় নবজাগরণের ক্ষেত্রে ততটা ভূমিকা নিয়েছিল সমাজ সংস্কারগন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সমাজ সংস্কার প্রভাবে ভারতীয় সমাজের যে অগ্রগতি ঘটেছিল তার প্রথম সূচনা হয়েছিল বাংলায়।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment