স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও আর্যসমাজ
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮২৪-৮৩ খ্রিস্টাব্দে নেতৃত্বে আর্য সমাজ হিন্দু ধর্মের সংস্কারের এক তীব্র ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তোলে। ব্রাহ্ম, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের আক্রমণ প্রতিরোধ এবং হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরীর সংস্কারের উদ্দেশ্যে তিনি আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেছেন কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামী, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা ও পৌত্তলিকতা ঘোর বিরোধী এবং একেশ্বরবাদ এর সমর্থক।
১. আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠান ও আদর্শ
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল বোম্বাইয়ের আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। আর্য সমাজের কার্যকল্যা মূলত স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর উদ্যোগে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত। ইংরেজি ভাষার অজ্ঞ, সংস্কৃত ভাষা ও শাস্ত্রে পন্ডিত দয়ানন্দা ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ ও ‘বেদভাষ্য’ নামে দুটি হিন্দি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থ দুটিতে আর্য সমাজের আদর্শ উল্লেখিত আছে।
২. শুদ্ধি আন্দোলন
আর্য সমাজের অন্যতম কর্মসূচি ছিল শুদ্ধি আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্মান্তরিত বোধ করে ভারতকে এক জাতি, এক ধর্ম ও এক সমাজ রূপে প্রতিষ্ঠিত করা। ভারতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বিশেষত পাঞ্জাবে তার ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
৩. নারী উন্নয়ন
আর্য সমাজ নারী সমাজের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। তারা সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। নারীদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও স্বাধীনতা দানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। তার স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে ঘটানোর বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।
৪. বেদের আদর্শ প্রাচার
স্বামী দয়ানন্দ মনে করতেন যে, পৃথিবীর সকল ধর্ম ও তত্ত্বের সারমর্মও নিহিত আছে বেদের মধ্যে। কিন্তু কিছু স্বার্থপর মানুষ বেদের ভুল ব্যাখ্যা করে সনাতন হিন্দু ধর্মকে কলুষিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। স্বামী দয়ানন্দ বেদের উপর নির্ভর করে আর্য সমাজের যাবতীয় আদর্শ নির্ধারণ করেন এবং প্রাচীন বৈদিক যুগের পবিত্র ও গৌরাঙ্গ হিন্দু ধর্ম পুণ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এজন্য দয়ানন্দ বলতেন, “বৈদিক শাস্ত্রে ফিরে যাও”।
৫. শিক্ষার প্রসার
শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে আর্য সমাজের উদ্যোগে গুরুকুল, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। উল্লেখযোগ্য বৈদিক বিদ্যালয় গুলি প্রতিষ্ঠিত হয় ফারুখাবাদ ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে, মির্জাপুর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে, কাশগঞ্জ ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে আলিগড় ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ও বরাণসী ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের প্রভৃতি স্থানে। এসব বিদ্যালয়ের সুপ্রাচীন সংস্কৃত ভাষা ও স্বাস্থ্যের মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে স্বামী দয়ানন্দ বিভিন্ন পদক্ষেপে গ্রহণ করেন। আব্রাহ্মণ ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত শিক্ষা দরজা খুলে দেওয়া হয়। তার মৃত্যুর পরবর্তীকালে লালা হংসরাজ লাহোরে দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক কলেজ ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দ হরিদ্বারের গুরুকুল আশ্রম ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন।
৬. গোরক্ষিন সভা
গরু হল হিন্দু ধর্মের পবিত্র প্রাণী। গোহত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে গোরক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। দয়ানন্দ এই প্রাণকে মানুষের পথিক হিসেবে তুলে ধরেন এবং মুসলিমদের গো হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। এর ফলে পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়।
৭. সমাজসেবা ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা
আর্য সমাজে অনাথ আশ্রম, বিধবারের আশ্রয় দানের জন্য আশ্রম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্যে উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং এর বিরুদ্ধে প্রচার ও কার্য চালায়।
৮. দয়ানন্দের পরবর্তী আন্দোলন
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মৃত্যুর পরবর্তীকালে আর্য সমাজের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেন লাল হংসরাজ, লালা লাজপৎ রায়, পন্ডিতগুরু দত্ত, স্বামী শ্রদ্ধা নন্দ প্রমুখ। এসব নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে আর্য সমাজের সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ দ্রুত পাঞ্জাব, গুজরাত, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
মূল্যায়ন
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও তার প্রতিষ্ঠিত আর্য সমাজ বেদের ওপর ভিত্তি করে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের যে সংস্কার সাধন করতে হন তা এক কথায় অসাধারণ। আর্য সমাজের সংস্কার আন্দোলন সমাজের গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। ১. শুভ্রাচীন বৈদিক হিন্দু ধর্ম ও তার হারানো গৌরব ফিরে পায়। ২. আর্য সমাজের আন্দোলনের ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের হীনম্মনৃতা দূর হয়। ৩. হিন্দু সম্প্রদায় তাদের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ৪. জাতপাতের বিভেদ অনেকটা দূর হলে হিন্দু সমাজে ঐক্য বৃদ্ধি পায়। ৫. ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাশ্চাত্য রীতি-নীতির সমন্বয় ঘটিয়ে বেশ আধুনিক শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেয়া হয়। ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে ভারতের চরমপন্থী রাজনীতির বিকাশে স্বামী দয়ানন্দ ও আর্য সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অরবিন্দু ঘোষ স্বামী দয়ানন্দ সম্পর্কে লিখেছেন, “ব্রোঞ্জের ওপর খোদাই কাজের মত সমকালীন মানুষের মন ও সমাজের উপর তার গভীর প্রভাব অঙ্কিত হয়েছিল।”