উনবি শতকের সংস্কার আন্দোলনের ফিল‌ওসফিক্যাল সোসাইটির ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো? মহারাষ্ট্রের সমস্যা সংস্কারের ক্ষেত্রে মহাদেব গোবিন্দ রাণাডের কি ভূমিকা ছিল?

সূচনা

উনবি শতকের দ্বিতীয় আর্ধে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় আলাপ আলোচনার উদ্দেশ্যে যেসব সংগঠন গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে অন্যতম থিওসফিক্যাল সোসাইটি। হেলেনা ব্লাভাটস্কি, কর্নেল এইচ. এস. ওলকপি উইলিয়াম কোয়ান জাজ আঠার ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র থিওসফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তারা মাদ্রাজের আদিয়াল-এ এই সোসাইটির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়।

থিওসফিক্যাল সোসাইটির ভূমিকা

১. উদ্দেশ্য

থিওসফিক্যাল সোসাইটির বিশেষ কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল, যেমন –

(১) থিওসফিক্যাল সোসাইটি জাতি, বর্ণ, ধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রতিক স্থাপন করে একতা গড়ে তুলতে চেয়েছিল।

(২) ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধানের স্বপ্ন দেখেছিল।

(৩) তারা প্রাচীন হিন্দু ধর্ম ও ঐতিহ্যকে নতুন করে জাগিয়ে তুলে এর দ্বারা ভারতের সামাজিক সমস্যা সমাধানের আশা পোষণ করত।

(৪) তারা ভারতের রাজনৈতিক পরাধীনতার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন।

২. অ্যানি বেসান্তের অবদান

শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ২১ মে ফিওসফিক্যাল সোসাইটি তে যোগ দেওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বেসান্তের উদ্যোগের থিওসফিক্যাল সোসাইটি সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অ্যানি বেসান্তের উদ্যোগে বারাণসীতে ‘কেন্দ্রীয় হিন্দু বিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে মদনমোহন মালব্য এ বিদ্যালয় কে ‘বারাণসী হিন্দু বিদ্যালয়’ এ পরিণত করেন। বেসান্ত স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। থিওসফিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে ‘থিওসফি’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করা হতো।

৩. ধর্মীয় সংস্কার

ঔপনিবেশিক শাসনকালে খ্রিস্টান মিশনারী ভারতীয় ধর্ম ও সভ্যতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালায় তা প্রতিহত করতে থিওসফিক্যাল সোসাইটি অনেকটা সফল হয়। প্রাচীন হিন্দু ধর্ম ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ তে বিশ্বাসী প্রাশ্চাত্য থিওসফিস্টার হিন্দু ঐতিহ্যের পক্ষে প্রচার শুরু করেন। ফলে ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাসে ফিরে আসে। কর্নেল ওলকটএর উদ্যোগে ভারতীয় সভ্যতার সুপ্রাচীন ও গৌরবময় ঐতিহ্য চারিদিকে প্রচারিত হয়।

থিওসফিক্যাল সোসাইটির সীমাবদ্ধতা

থিওসফিক্যাল সোসাইটির কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এগুলি হলো –

(১) এই সোসাইটি ধর্মীয় ক্ষেত্রে কুসংস্কার এর অবসান ঘটিয়ে প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনর্জাগরন ঘটাতে পারেনি।

(২) তাদের কার্যকলাপ প্রধানত শহর অঞ্চলের সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামের অভন্ধরের এই সোসাইটি বিশেষ করে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

(৩) তাদের কার্যকলাপ প্রধানত সমাজের এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সোসাইটির বিশেষ প্রভাব পড়েন।

(৪) থিওসফিক্যাল সোসাইটির আন্দোলন মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার অন্যান্য ধর্মের মানুষ এই আন্দোলনের থেকে দূরে সরে ছিল। তা সত্বেও বলা যায় যে, আধুনিক ভারতের ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু লিখেছেন যে, “থিও সফিক্যাল সোসাইটি ভারতীয় মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।”

মহাদেব গোবিন্দ রাণাডের ভূমিকা

মহারাষ্ট্রের সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ১৮৪২-১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। বোম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রার্থনা সমাজের প্রাণপুরুষ রাণাডের উদ্যোগে মহারাষ্ট্র তথা পশ্চিম ভারতের সমাজ সংস্কার আন্দোলন অত্যন্ত সক্রিয়। তিনি জাতীয় ঐতিহ্য বা গৌরবে কথা মনে রেখে সমাজ সংস্কারের উদ্যোগ নেন। তিনি বলেছেন যে, “আমরা আমাদের অতীত এবং আমাদের সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাই না।”

১. আদর্শ

মহাদেব গোবিন্দ রানাডে প্রগতিশীল মানসিকতার অধিকারী। তিনি পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার উন্নতি ঘটাতে চেয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পর্দা প্রথা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতির বিরোধিতা এবং বিধবা বিবাহ ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে তিনি সমর্থন করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় সমাজের উন্নতি ঘটানো সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন।

২. বিধবা বিবাহ সমিতি প্রতিষ্ঠা

মহাদেব গোবিন্দ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ সমিতির প্রতিষ্ঠা করে। এই সমিতি বাল্যবিধবাদের স্বার্থরক্ষা ও বিধবাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে।

৩. প্রার্থনা সমাজে যোগদান

উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত প্রার্থনা সমাজ। মহারাষ্ট্রের সমাজ সংস্কার আত্মারাম পান্ডু রঙ্গ ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা কেশব চন্দ্র সেন এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে বিচারপতি মহাদেব গোবিন্দ ও রানাডে এই ঐতিহাসিক রামকৃষ্ণ ভান্ডার কর প্রার্থনা সমাজে যোগ দিলে এই সমাজে জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং প্রার্থনা সমাজের সংস্কার আন্দোলন খুব প্রগতিশীল হয়ে ওঠে। প্রার্থনা সমাজের উদ্দেশ্যগুলিকে বাস্তবায়িত করার জন্য রানাডায আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে যান।

৪. সর্বজনিক সভা প্রতিষ্ঠা

রানাডে ভারতীয়দের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় সর্বজনীন সভাপতি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভাপতি স্টার মধ্যে দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কল্যাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

৫. শিক্ষা সমাজ গঠন

শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে রানাডের ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য শিক্ষা সমাজ বা ডেকান এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কোন প্রকার সরকারি সাহায্য ছাড়াই পুনায় ফারগুসন কলেজে এবং সাংলিতে উইলইংডন কলেজে প্রতিষ্ঠা হয়। শিখা ও সংস্কার বিষয়ে আলোচনা চালানোর উদ্দেশ্যে তার উদ্যোগ মাদ্রাজে ভারতীয় জাতীয় সমাজ সম্মেলনে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে আহ্বান করা হয়।

মূল্যায়ন

মহাদেব গোবিন্দ রানাডের উদ্যোগে মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ ও অন্ধের তেলেগু ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রার্থনা সমাজ যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রানাডে তার সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, সংস্কারের বিরোধিতা করলে সমাজের আরো অবক্ষয় ঘটবে। জেরাল ডাইন ফরবেশ বলেছেন যে, রাণাডে সংস্কার কামি কর্মসূচি ও ঐতিহ্যশালী সমাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।” দীনবন্ধু এন্ড্রুজ এরমধ্যে সংস্কারক হিসেবে তিনি রামমোহন ও স্যার সৈয়দ আহমদের প্রায় কাছাকাছি ছিলেন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment