জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও নবভারত গঠনে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো?

পরাধীন ভারতের দিশেহারা ও আত্মবিশ্বাসীন জাতিকে জাতীয়তাবাদের উদ্বুদ্ধ করে যারা জাতির সঠিক পথে দিশা দেখিয়েছেন, তাদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য হলেন শ্রী রামকৃষ্ণের প্রিয় শীর্ষ স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৬৩-১৯০২ খ্রিস্টাব্দে। তার জাতীয়তাবাদী আদর্শ, স্বদেশের চেতনা ওদেশ প্রেম দেশের যুবসমাজকে তীব্র স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তার উদাত্ত আহ্বানে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত আপামর ভারতবাসীর হৃদয় আন্দোলিত হয়। ঋষি অরবিন্দের মতে, বিবেকানন্দই আমাদের জাতি জীবনের গঠন কর্তা ও প্রধান নেতা। নব ভারতের অন্যতম রূপকার স্বামীজি প্রতিশ্রদ্ধা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, “ভারতবর্ষকে জানতে হলে বিবেকানন্দকে পড়তে ও জানতে হবে।”

জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিবেকানন্দ

শুভ প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে উনবিংশ শতকে। ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশ এদের ভূমিকা সর্বাধিক তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।

১. জাতীয়তাবাদী আদর্শ

একজন ধর্মীয় নেতা হওয়ার সত্ত্বেও স্বামী বিবেকানন্দ পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করতে দেশের যুব সমাজকে আহ্বান জানায়। তার মহাজাগরণের গুণাবলী দেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়। স্বামীজি রচিত ‘জ্ঞানযোগ’, ‘রাজযোগ’, ‘বর্তমান ভারত’, ‘পরিব্রাজক’, প্রভৃতি গ্রন্থি এবং বিভিন্ন পত্রাবলী বিপ্লবীদের জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় উৎস ছিল। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের মতে, “বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবন গঠনকর্তা। তিনি ইহার প্রধান নেতা।” ঐতিহাসিক আর. জি. প্রধান তাকে আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন।

২. স্বদেশ প্রেমের অগ্রদূত

প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে স্বামীজীর কোন সংশ্রব না থাকলেও তিনি বলেছেন মুর্ত প্রতীক। যুব সমাজের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ভারত মাতা আমাদের আরাধ্য দেবতা। অন্যান্য ওকে জো দেবতাদের ভুলে গেলে ক্ষতি নেই। তিনি বলেছেন যে, জন্ম থেকে মানুষ মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত। এই মা হলেন দেশমাতা। স্বামীজি উদাত কন্ঠে ঘোষণা করেন যে, “ভারতবর্ষে আমাদের ভাই, ভারতবর্ষে আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বরাণসী।” দেহত্যাগের কিছুদিন আগে স্বামীজি বলেন – “এই মুহূর্তে ভারতের প্রয়োজন হল বোমা।”

৩. স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপিত

স্বামীজীর বাণী ও উদাত্ত আহ্বানে উদ্দীপ্ত হয়ে দেশের যুব সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন ঝরা দিনগুলো স্বামীজি ছিলেন বিপ্লবীদের আদর্শ। স্বামীজি বলেন, কেবলমাত্র সাহসী শক্তিমানরাই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। গোপাল হালদারের মতে বাংলাদেশকে যদি কেউ বিপ্লবী মন্ত্রে জাগিয়ে থাকেন, তিনি বিবেকানন্দ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ‘ভারত পথিক’এ উল্লেখ করে বলেছেন যে, “স্বামীজীর বাণী ও রচনা বলি আমার চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল।”

৪. জাতীয়তাবাদের স্বরূপ

স্বামীজি মাতৃভূমির শৃঙ্খলমোচনে পাশাপাশি মানব মুক্তির কথা বলেন। বিবেকানন্দ ধর্ম হল ‘মানুষ তৈরীর ধর্ম’ । তার মতে, “যে ধর্মে বালবিধবার অশ্রু মোচন করতে পারেনা, যে ধর্মে পিতা মাতৃহীন অনাথের মুখে এক টুকরো রুটি তুলে দিতে পারে না, সে ধর্ম আমি বিশ্বাস করি না।” মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতে, স্বামীজীর জাতীয়তাবাদ হল আধ্যাত্ম সাম্রাজ্যবাদ। বিপিনচন্দ্র পালের মতে, স্বামীজির স্পর্শে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন একটি আধ্যাত্মিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।

নবভারত গঠনে বিবেকানন্দ

স্বামী বিবেকানন্দ পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করে একটি নতুন ভারত গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে বস্তুবাদের সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের সমন্বয় ঘটবে।

১. স্বামীজীর স্বপ্নের ভারত

স্বামী যে এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে শোষণ, নিপীড়ন, খুদা জ্বালা থাকবে না। তিনি আশা করেছিলেন প্রকৃত মানুষদের নিয়ে নতুন ভারত গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, “নতুন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে, চাষাড়া কুটির ভেদ করে, জেলে-মালা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওলার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।” সতীশ চন্দ্র বসুর মতে, স্বামীজির স্বপ্ন ছিল জাগ্রত ভারত, সমুন্নত ভারত, একযোগে স্বাধীন ভারত।

২. স্বদেশ ও দেশবাসীর মুক্তির সাধনা

স্বদেশ দেশবাসীর মুক্তি ছিল স্বামীজীর ভারত সাধন মূল বিষয়। তিনি ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলে তাদের এগিয়ে চলার মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলেন। ভারতবর্ষের প্রতি তিনি আহ্বান জানান, “সদর্পে বল আমরা ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই।” তিনি আরো বলেন, “ভারতবর্ষে আমার ভাই, ভারতের সমাজ আমরা শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী। বল ভাই-ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।”

৩. সমন্বয়ের আদর্শ

স্বামীজি ভারতবাসীকে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধারশীল করে। তিনি চেয়েছিলেন প্রাচ্য-প্রশ্চাত্য এবং চীন ও আধুনিক ভারতীয় জীবনাদর্শনে সামন্বয়ের মাধ্যমে উচ্চনীচ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ সবার প্রতিযোগিতায় নবভারত গঠন করতে, সেখানে প্রাচীন ভারতের জীবনাদর্শনের সঙ্গে পাশ্চাত্যের কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটবে।

৪. আদর্শ যুব সমাজ গঠনের প্রেরণা

স্বামীজি ছিলেন যুব সমাজের অনুপ্রেরণা। তিনি ভারতের পরাধীনতার মুক্ত করে নতুন ভারত গঠনের ক্ষেত্রে যুবশক্তির ওপর ভরসা করতেন। তিনি যুব সমাজকে লৌহ কঠিন পেশী, ইস্পাত কঠিন চরিত্র ও বজ্রদীপ্ত মনের অধিকারী হওয়ার আহ্বান জানান। তার বিশ্বাস ছিল যে, একশত খাঁটি আদর্শবাদী যুবক মিলিত হলে ভারতের স্বাধীনতা লাভ অবশ্যম্ভাবী। তিনি বলেন -“গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালো।” তিনি চেয়েছিলেন, যুবসমাজ আগুন ছড়িয়ে দেবে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

৫. রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠান

বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগোর বিশ্বধর্ম সম্মেলনে হিন্দু ধর্মের অদ্বৈত বেদান্ত বাদের জয় ঘোষণা করেন। তার ধর্ম হলো : মানুষের তৈরি ধর্ম’ । মানবিক আদর্শ ও সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্যে স্বামীজি ১ মেয়ে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠান করেন। এই মিশনের লক্ষ্য ছিল-

(১) রামকৃষ্ণের আদর্শ প্রচার : মানবের হিতার্থে শ্রীরামকৃষ্ণ যেসব তথ্য ব্যাখ্যা করেছেন বা নিজ ও জীবনে প্রয়োগ করেছেন সেগুলি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা।

(২) সামাজিক কাজ : মানুষের সংসারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বিদ্যা দানের উপযুক্ত লোক শিক্ষিতকরণ, শিল্প ও শ্রমজীবীদের উৎসাহ-বর্ধন এবং বিশ্বের দরিদ্র, অবহেলিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখ মোচন করায় রামকৃষ্ণ মিশনের মূল কাজ। ভারতের অভ্যন্তরে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ৮৩ টি শাখা আছে। ভারতের বাইরে ও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ১১২ টি শাখা ছড়িয়ে রয়েছে। ধর্মীয় ঐক্য ও বৈদান্তিক আদর্শের বিশ্বব্যাপী প্রচার এই মিশনের উদ্দেশ্য হলেও এর আসল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে দেব জ্ঞানের সেবা করা। জীবনী তার কাছে শিব। তাই তার অভিঃমন্ত্র ছিল- “সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা তুমি সেবিছে ঈশ্বর জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”

উপসংহার

স্বামীজি মানবত্মার মধ্যে দেবাত্মাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। স্বদেশ ও স্বদেশবাসী পাশাপাশি বিশ্ব মানবত্মার মুক্তি লাভই ছিল তার স্বপ্ন। আর. জি. প্রধানের মতে, স্বামী বিবেকানন্দের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বলা যেতে পারে। স্বামীজি নতুন ভারতে গঠনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাকে অনুসরণ করেন স্বাধীন ভারতের নেতৃবৃন্দ নতুন ভারত গঠনের প্রয়াসী হয়েছেন। স্বামীজীর স্মরণ করে আজও প্রতিবছর ১২ ই জানুয়ারি তার জন্মদিনটি যুবদিবস হিসেবে পালিত হয়। ফরাসি পণ্ডিত রোমা রোঁল্যা বলেছেন যে, “স্বামীজীর সর্বজনীন আত্মা মানবত্মার পর্জবসিত হয়েছিল।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment