ডিরোজিওর নেতৃত্বে বাংলায় সংস্কার আন্দোলন
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ১৮০৯-১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি কলকাতায় এন্টালি অঞ্চলে এক ইঙ্গ পর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ডেভিড ড্রামডের ধর্মতলা একাডেমিতে শিক্ষা লাভ করেন। উনবি শতকে বাংলার সংস্কার আন্দোলনের প্রলয়শিখা ডিরোজিও ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ বছর বয়সে হিন্দু কলেজে ইংরেজি ও ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। শিক্ষাদানের প্রতি তার প্রবাল উৎসাহ এবং ছাত্রদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ যোগসূত্র স্থাপনে হিন্দু কলেজে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইয়ং বেঙ্গল দল। রামমোহন রায় সমাজ সংস্কারের যে মহাযজ্ঞ শুরু করেন ডিরোজিও তাতে ঘৃতাহুতি দেন। তার নেতৃত্বে বাংলা সংস্কার আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
১. ডিরোজিওর আদর্শ
ডিরোজিও বিনা বিচারে কিছুই না মেনে যুক্তি দিয়ে বিচার করে সবকিছু গ্রহণ করার জন্য তার ছাত্রদের পরামর্শ দেন। তিনি তার ছাত্রদের সঙ্গে সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান দেশপ্রেম প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় খোলামেলা আলোচনা করতেন। তিনি ছাত্রদের বলেন যে, স্বাধীনতার চিন্তার দ্বারা মদ ও পথ স্থির করবেন ; কোন প্রচলিত সংস্কার অন্ধভাবে অনুশীলন করবেন না ; সৎ গুন অনুশীলন করবেন, আর যা কিছু অন্যায় তা অসৎ বা পরিহার করবেন। তার তার প্রেরণায় ছাত্ররা লক, হিউম, ভলতেয়ার, রুশো, টম পেইন, বার্কলে প্রমুখ দার্শনিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হন।
২. অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা
ডিরোজিওর প্রভাবে তার অনুগামী ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটে। ছাত্রদের মধ্যে সত্যানুসন্ধানে মানসিকতা করে তুলতে তিনি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে মানিক তলায় অ্যাকাডেমী অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভা জাতিভেদ প্রথা অস্পৃশ্যতা, মূর্তি পূজা, সতীদাহ প্রভৃতি বিরোধিতা করে। এখানে ডিরোজিওর অনুগামী ছাত্ররা প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতো। এই প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র ছিল এথেনিয়াম।
৩. পত্রপত্রিকায় প্রচার
সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিজেদের যুক্তিবাদী ভাবধারা প্রচারের উদ্দেশ্যে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ করে। তারা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পার্থেনন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এতে নারী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাদের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘ক্যালেইডোস্কপ’ পত্রিকায় ভারতের ব্রিটিশ শাসন বিরোধিতা করা হয়। এছাড়া তিনি ‘হেসপেরাস’ ও ‘ক্যালকাটা লিটারি গেজেট’ নামে দুটি পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
৪. রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে আক্রমণ
ইয়ং বেঙ্গল হিন্দু ধর্মে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে। তার গোমাংস খেতে এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিত তাদের লক্ষ্য করে বলতেন, “আমরা গোমাংস খাই গো।” তারা গঙ্গা জলে পবিত্রতা বিশ্বাস করতে না এবং নিজেদের উপবিত ছিঁড়ে ফেলেন। তারা কালীঘাটের মন্দিরের মা কালীকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, ‘মহাশয়, প্রাতঃপ্রণাম’ তারা মঙ্গল গঙ্গা জলে পবিত্রতা মানে না।
৫. দেশাত্মবোধক
ডিরোজিও পর্তুগিজ পরিবারের জন্মগ্রহণ করলে অতি নিয়েছিলেন মনে প্রানে ভারতীয়। তার লেখা ‘ফকির অব জঙ্গিরা’ ও ভারতবর্ষে আমরা স্বদেশের প্রতি (“To India -My Native Land’) কবিতা এদেশের প্রতি তাদের দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে। ভারতের প্রতি ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের আকৃতি ভালবাসা ছিল।
৬. সামাজিক আলোড়ন
ইয়ং বেঙ্গল দের হিন্দু ধর্ম বিরোধী সংস্কার আন্দোলনে সমাজের তীব্র আলোড়ন ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। হিন্দু কলেজে বহু ছাত্রদের অভিভাবক আশঙ্কিত হন যে, ডিরোজিওর ভাবধারা তাদের সন্তানের ক্ষতি করবে। এই জন্য তাদের সন্তানদের অন্য কলেজে সরিয়ে নিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ডিরোজিওকে অভিযুক্ত করে হিন্দু কলেজে কর্তৃপক্ষ তাকে পদচ্যুত করে। এর কিছুকাল পর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের মাত্র ২২ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
ডিরোজিওর মৃত্যুর পর ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন
ডিরোজিওর মৃত্যুতে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তার আদর্শ হারিয়ে যায়নি। তার মৃত্যুর পর তার অনুগামীরা ইয়ং বেঙ্গল আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যান। তার অনুগামীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রে লিখেছেন যে, “ডিরোজিও তিনি বৎসর মাত্র হিন্দু কলেজের ছিলেন, কিন্তু এই তিন বৎসরের মধ্যে তাহার শীর্ষ দলের মনে এমন কিছু রোপন করিয়েছিলেন, যাহা তাদের অন্তরে আমরণ বিদ্যমান ছিল।”
১. পত্রপত্রিকা ও সভাসমিতি
ডিরোজিওর অনুগামী ‘জ্ঞানান্বেষন’ , ‘এনকোয়ারার’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশ করে তাদের ভাবদর্শ প্রকাশ করেন। তারা বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তাদের সংস্কার্য চালিয়ে যান। তাদের উদ্যোগে ‘সাধারণ জ্ঞানপার্জনী সভা’ প্রতিষ্ঠিত ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের উদ্দেশ্যে তারা ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
২. সংস্কার কর্মসূচি
ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা নারী-আবার মুখ চালাচ্ছে পুরুষের মধ্যে অসাম্য নারী নির্যাতন, দাস প্রথা, বেগার প্রথা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, মরিশাসে ভারতীয় কুলি প্রেরণ, ব্রিটিশের একচেটিয়া বাণিজ্যধিকার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অন্যান্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধিতা করেন।
মূল্যায়ন
স্বদেশের প্রতি অগাধ ভালবাসা থাকলেও ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে উগ্র মনোভাব পোষণ করতেন। ফলে দেশবাসী ও তাদের গ্রহণ করেননি। এজন্য সময়কালে ও পরবর্তীকালে তাদের সম্পর্ক পরস্পর বিরোধী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। ১. তাদের সমকালে ও পরবর্তীকালে অনেকেই তাদের ‘উচ্ছৃঙ্খল’, ‘কালো পাহাড়’ ও ‘সমাজ-বিচ্ছিন্ন একটি উগ্র গোষ্ঠী’ হিসেবে দেখেছেন। ডক্টর সুমিত সরকার বলেছেন যে, মুষ্টিমেয়ে বুদ্ধিজীবী ছাড়া বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশের উপর তাদের প্রভাব ছিল শূন্য। ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠী তাদের আন্দোলনের কোনো অর্থ খুঁজে পাননি। ২. আবার অনেকেই বাংলা সংস্কার আন্দোলনে তাদের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। কৃষ্ণ দাস পাল তাদের ‘দেশের ভবিষ্যৎ’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিশোরী চাঁদ মিত্র ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার’ সঙ্গে ইয়ং বেঙ্গলি তুলনা করেছেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের প্রশংসা করে বলেছেন যে, “তারা আমাদের জাতির পিতা, তাদের গুণাবলী চিরস্মরণীয়।” না না ত্রুটি বিচ্যুতি এবং সমালোচনার সত্ত্বেও জাতীয় জীবনের ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর অবদান কখনোই অস্বীকার করা যায় না।