ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো?

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার

ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রাচীন ভাষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবি, ফরাসি ও সংস্কৃত ভাষায় মাধ্যমে শিক্ষাদান চলত। কিছু সাধারন বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞান ও ধর্মীয় কাহিনী পাঠের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদান সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রায় প্রতিটি গ্রামে এরূপ পাঠশালা ছিল বলে ওয়ার্ড তার বিবরণে উল্লেখ করেছেন। বাংলা প্রদেশে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় এক লক্ষ পাঠশালা ছিল বলে উইলিয়াম অ্যাডাম এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতের বিভিন্ন উদ্যোগে প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে নিজে আলোচনা করা হলো-

১. সরকারি অনিচ্ছা

ভারতের ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠার প্রথম পূর্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ইংরেজ ও পশ্চাতে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে আগ্রহী ছিল না। কোম্পানি মনে করছ যে, প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে এবং এ দেশের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে। এইজন্য কোম্পানি এ দেশের সংস্কৃত ও আরবি ফরাসি শিক্ষাকে উৎসাহ দেয়। এই উদ্দেশ্যে কলকাতা মাদ্রাসা ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে, এশিয়ারটিক সোসাইটি ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে, বারাণসী সংস্কৃত কলেজ ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. বিদেশী ব্যক্তিগত উদ্যোগ

ভারতের সর্বপ্রথম একটি সুসংবদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানাই কোম্পানি অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চাল গান্ট। প্রমে এদেশে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি অফিস, আদালত ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার প্রকৃতি স্থাপিত হতে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভারতীয়দের ইংরেজি জ্ঞান এর প্রয়োজন ছিল। সরকারি চাকরি লাভের আশায় মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই চাহিদা মেটানোর জন্য কলকাতা কিছু বিদেশি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শোরবোর্ন, মার্টিন, আরটুন পিটার্স, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়।

৩. শ্রীরামপুর মিশনারীদের উদ্যোগ

ভারতের খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে উদ্দেশ্যে শীরামপুর খ্রিস্টান মিশনারী বা ধর্মপ্রচারকগণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজ ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। মার্শম্যান, হোয়াট ও উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরের ব্যাপস্টিট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের উদ্যোগে বাংলা সহ মোট ২৭ টি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুমোদিত হয়। তাদের উদ্যোগে কলকাতা, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থান, এমন কিছু চুঁচুড়া, বর্ধমান, কালনা, বহরমপুর ও মালদা এবং বিভিন্ন ভারতের বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীরামপুর ব্যাপস্ট্রিট মিশনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মোট ১২৬ টি বিদ্যালয় প্রায় দশ হাজার ভারতীয় ছাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে। তাদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে।

৪. অন্যান্য মিশনারীদের উদ্যোগ

শ্রীরামপুর খ্রিস্টান মিশনারি ছাড়াও অন্যান্য বেশ কয়েকটি মিশনারি গোষ্ঠী ভারতে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লন্ডন মিশনারী সোসাইটি বা চার্চ মিশনারি সোসাইটি। তাদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানসহ দক্ষিণ ভারতে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কটিশ মিশনারী আলেকজান্ডার ডাব বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন।

এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জেনারেল অ্যাসেম্বেলিজ ইনস্টিটিউট ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে। এ ছাড়া মিশনারীদের উদ্যোগে শিবপুরে বিশপ কলেজ ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে, মাদ্রাজি খ্রিষ্টান কলেজ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে, বোম্বাই এ উইলসন কলেজ ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মিশনারীদের প্রতিষ্ঠান বিদ্যালয় গুলিতে ইংরেজ, আধুনিক বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল ও ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো।

৫. অন্যান্যদের উদ্যোগ

কয়েকজন মুক্ত মানা ব্যক্তি ও ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, দ্বারকা নাথ ঠাকুর, জয় নারায়ণ ঘোষাল, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ। কলকাতায় রামমোহন রায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাংল হিন্দু স্কুল এবং ডেভিড হেয়ার ১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ডেভিড হেয়ার রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে এবং ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক রচনা সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে গঠিত কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটির সদস্যরা কলকাতা একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন রায় তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে একটি চিঠি লেখেন ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত শিক্ষায় পরিবর্তে ভারতের আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান। এই চিঠি ভারতে নবজাগরণের ইতিহাস একটি মূল্যবান দলিল।

৬. সরকারি ঘোষণা

ব্রিটিশ সরকারের কয়েকটি ঘোষণা ভারতের প্রাচাতৃ শিক্ষার প্রসারের সহায়তা করে, যেমন –

(১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার আইনের দ্বারা ঘোষণা করে যে ভারতে যৌন শিক্ষার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতি বছর এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবে।

(২) জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার পোশাকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

(৩) উডের ডেসপ্যাচ ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে অনুসারে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে অনুসারে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

উপসংহার

ভারতে উনবি শতকের প্রথমার্ধে সবচেয়ে বেশি পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে সরকারি উদাসীনতার সঙ্গে পরবর্তীকালে প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এ ব্রিটিশ সরকার সক্রিয় উদ্যোগ নেয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি জ্ঞানকে আগ্রাধিকার দেয়া হবে। এরপরে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মধ্যবিত্ত আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার আরো প্রসার ঘটে।

কিন্তু ঈদের মধ্যে মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রাশ্চাত্য ও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে সেই হারে সরকারি চাকরি পায়নি। পশ্চিম দক্ষিণ ভারতে উচ্চ শিল্প ও বাণিজ্য এবং দেশীয় রাজাদের কাজে নিযুক্ত হলে অপূর্ব ভারতের সে যুগে ছিল খুব কম। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশন সুপারিশ অনুসারে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান কমিয়ে দেয়। কিন্তু মধ্যবিত্তদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিপুল চাহিদা থাকে বেসরকারি উদ্যোগের সারা ভারতে একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment