ব্রিটিশ শাসনকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও ব্রিটিশ সভ্যতার সংস্কৃতি অনুরাগে একটি ভারতীয় জনগোষ্ঠী উদ্ভব ঘটে। এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত হয়। বি. বি. মিশ্র উদ্ভবের ভিত্তিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন, যথা -(১) ভূমিজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি (২) শিল্প মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং (৩) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ব্রিটিশ ভারতের উদ্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কতগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন-
১. প্রাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ
ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন উদ্যোগে ভারতের প্রাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ ঘটে। নবোণ্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ করে। রাস্তা তো শিক্ষায় শিক্ষিত এই শ্রেণি আধুনিক প্রাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুরাগী ছিল। ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের ফলে তারা ভারতীয় সমাজে সর্বাধিক প্রগতিশীল শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা মনে করত যে, ভারতের ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের পক্ষে আশীর্বাদে স্বরূপ কারন ব্রিটিশদের ভারতের আগমনের ফলেই এদেশে আধুনিকতার জোয়ার আসে। তাই ডিরোজিওর অনুগামী রাম গোপাল ঘোষ বিজয় সরকারের চাকরি প্রত্যাখ্যান করলেও ভারতের ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব কামনা করেছিলেন।
২. উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্য
ভারতের ব্রিটিশ শাসনের ছত্রছায়ায় যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছিল তাতে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের আধ্যাত্মিক প্রাধান্য ছিল। অধ্যাপক সুমিত সরকার দেখেছেন যে ১৮৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষে বাংলার হিন্দু কলেজের ছাত্রদের ৮৪. ৭% এসেছিল ব্রাহ্মণ, কায়েস্থ ও বৈধ এই তিনটি তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেণী থেকে। সরকারি চাকরি বেশিরভাগটাই তাদের করায়ত ছিল। উচ্চশিক্ষা লাভ ও সরকারি চাকরির নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল সামান্য।
৩. সংখ্যাল্পতা
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল দরিদ্র এবং আধুনিক শিক্ষা বিমুখ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল দেশের প্রথম জনসংখ্যা অনুপাত খুবই কম। বিশ শতকের প্রথম দশকে ইংরেজি জানা ভারতীয়দের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র এক শতাংশ।
৪. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
ব্রিটিশ শাসনকালে আবির্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল। আর্থিক সচলতার ফলে সাধারণ ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছিল। মধ্যবিত্তের মধ্যে অনেকেই ছিল ভূস্বামী, জমিদার, মাহাজন, প্রচুর সম্পত্তির মালিক, পুঁজিপতি, ব্যবসায়িক প্রমুখ। মধ্যবিত্তের মধ্যে সংখ্যার সর্বাধিক ছিলেন মাঝারি আর্থিক সংগতি সম্পন্ন। তারা বিভিন্ন সরকারি অফিস আদালতে চাকরি করতেন। রাস্তা তো শিক্ষা গ্রহণকারী দুর্বার আর্থিক অবস্থা নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচিত হতো। মধ্যবৃত্তির মধ্যে যাদের আয় কম ছিল তারাও দরিদ্র ভারতীয়দের যে যথেষ্ট সচ্ছন্দের জীবনধারণ করতো।
৫. বেকারত্ব
মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন। পরবর্তীকালে ভারতে উচ্চশিক্ষায় প্রসার ঘটলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের সংখ্যা ও যথেষ্ট বেড়ে যায়। কিন্তু সেই তুলনায় সরকারি অফিস আদালতে চাকরির পথ বাড়েনি। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বহু মানুষ পরবর্তীকালে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে বেকার হয়ে পড়ে। তাছাড়া সরকারি উচ্চপদ গুলি ব্রিটিশদের জন্য সুরক্ষিত থাকায় উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন ভারতীয়রা তাদের যোগ্যতার চেয়ে অনেক নিচু পদে নিযুক্ত হতে বাধ্য হয়। অধ্যাপক আমলের ত্রিপাঠি দেখিয়েছেন যে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মাসে গাজা তো টাকার বেশি বেতন সরকারি পদে সংখ্যা ছিল ১৩, ৪৩১ টাকা।
৬. শহরকেন্দ্রিকতা
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের প্রাশ্চাত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকারি অফিস আদালত গুলি প্রধান ছিল শহরে গড়ে উঠেছিল। ফলে প্রধানত শহর গুলিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল। শহর গুলিতে কেন্দ্র করে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বহু ক্ষেত্রে তারা গ্রাম ও গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
৭. সম্প্রদায়িক পক্ষপাতি
ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নিজেদের সম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকতেন। তারা সর্বদা নিজের সম্প্রদায় ও তাদের মানুষজনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালাতেন।
৮. জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব
রাস্তা তো শিক্ষায় শিক্ষিত ও ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যার বিচার খুব সামান্য হলেও তারাই পরবর্তীকালে ভারতের বিরোধী জাতি আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। এইজন্য এ. আর. দেশাই ভারতের মধ্যবিত্ত আধুনিক ভারতের স্রষ্ঠা বলে অবহিত করেছেন। আধুনিক প্রাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয় এবং ব্রিটিশ অপসানের বিরুদ্ধে তাদের জ্ঞানের চোখ খুলে যায়। মূলত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া আদায় এর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা সমিতি গড়ে তোলে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও চাকরি করতে বরখাস্ত হওয়ার ফলেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
উপসংহার
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে, তারা প্রথম পর্বে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতের ব্রিটিশ শাসন ও সভ্যতার একনিষ্ঠ অনুরাগী পরিণত হয়েছিল। তাদের ওপর ভিত্তি করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রসার ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতের সর্বপ্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের শবর হয়ে প্রতিরোধকে ডাক দেয় এবং গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।