এশিয়া উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার বিবরণ দাও ?

সূচনা : উনিশ শতকের মাঝে মাঝে সময়কার ইউরোপীয় দেশ গুলি উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ গড়ে তোলার লক্ষ্মী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ইউরোপীয় জাতি গুলির কাছে এশিয়া মহাদেশ ছিল উপনিবেশ গড়ে তোলার এক লোভনীয় ক্ষেত্র। শিল্পের প্রয়োজনীয়তা কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদিত শিল্প পণ্য বিক্রয়ের খোলা বাজার তৈরি এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ধর্মপ্রচার প্রভৃতি নানা উদ্দেশ্য তৈরি নিয়ে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী এশিয়া মহাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমে এই সমস্ত জাতি গোষ্ঠীগুলি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের লক্ষ্য নিয়ে প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে তারা ওই সমস্ত দেশে নিজে নিজে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তথা ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করে।

এশিয়ায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা

১. ভারতের উপনিবেশ

ভারত প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীগুলিকে প্রলুদ্ধ করে। ফলস্বরূপ একে একে ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠী গুলি বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভারতের প্রবেশ করে। অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠী গুলি কে হটিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদের নিজেদের একাধিকপত্য কায়েম করে। পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ, দেওয়ানি লাভ এবং পরবর্তী সময়ে সিপাহী বিদ্রোহ ও দমনের মধ্যে দিয়ে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুদৃঢ় হয়।

২. দূর প্রাচ্যে উপনিবেশ

(১) চীন : ষোড়শ শতকে সর্বপ্রথম পর্তুগিজ বণিক সম্প্রদায় দক্ষিণের ম্যাকাও বন্দর দিয়ে চীন প্রবেশ করে। তাদের অনুসরণ করে একে একে স্পেন, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ ও ফরাসি বণিকরা ও চীনে প্রবেশ করে এবং বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। চীন সরকারের সঙ্গে ইংরেজদের প্রথমে অহিফেন যুদ্ধ বাদে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। পরে ব্রিটিশ ও ফরাসি জোটের সঙ্গে দ্বিতীয় যুদ্ধ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম অহিফেন যুদ্ধে হেরে গিয়ে চীন নানকিং সন্ধি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরে এবং দ্বিতীয় আহিফেন যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন তিয়েনসিন সন্ধি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই দুই সন্ধি স্বাক্ষরের পর চিনে বিদেশীদের অবাধ অনুপ্রবেশ শুরু হয় এবং চীনে সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ইউরোপীয় দেশ গুলি চীনকে তরমজুর ফালির মতো টুকরো করে নিয়ে নিজেদের দখলদারি কায়েম করে।

(২) জাপানের উপনিবেশ : উদীয়মান সূর্যের দেশ জাপানের সর্বপ্রথম মার্কিন সেনাপতি কমুদর ম্যাথু পদার্পণ করেন ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে একে একে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু পরবর্তী সময় জাপানে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটলে জাপান পূর্বেকার চুক্তি গুলির বাতিল করে দেয়। এরপর জাপানে নিজে সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। চীনের অধীনস্থ করিয়া দখল করে জাপান অগ্রসর হলে চীন জাপান যুদ্ধ ১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাধে। এই যুদ্ধে চীন হেরে গেলে শিননোসেকির সন্ধি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ দ্বারা জাপান চীনের কাছ থেকে বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ এবং বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করে।

৩. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি দেশে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ কায়েম হয়।

(১) সিংহলে : ওলন্দাজ বণিক শক্তি সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় নিজেদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু ইংরেজিদের অনুপ্রবেশ ঘটলে ওলন্দাজরা সিংহল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ‘অ্যামিয়েন্সের সন্ধি’ (১৮০২ খ্রিস্টাব্দ)-এর ফলে সিংহল ইংল্যান্ডের অধীনস্থ হয়। ইংরেজরা সর্বপ্রথম সিংহলের চা ও রবারের চাষ শুরু করে।

(২) মালয়ে : মালয়ে প্রথমে একাংশ পর্তুগিজরা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু পরের সিঙ্গাপুরসহ সমগ্র মালয়ের ওপর পর্তুগিজরা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ধীরে ধীরে টিন ও রাবারের সমৃদ্ধ মালয় বিশ্বায়ক সমৃদ্ধি শালি ব্রিটিশ উপনিবেশ হয়ে ওঠে।

(৩) ব্রাহ্মদেশ : ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের অবস্থিত ব্রহ্মদেশ বর্তমানে মায়ানামার ব্রিটেন অধিকার মুক্ত হয়েছিল। প্রথমে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ ও দ্বিতীয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ ইঙ্গ-ব্রহ্মা যুদ্ধে জিতে ব্রহ্মা দেশে সঙ্গে ইয়ানদাব সন্ধি স্বাক্ষর এর মাধ্যমে বৃটিশ ব্রহ্মদেশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের অধীনে আনে। তৃতীয় ইঙ্গ ব্রহ্মা যুদ্ধ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে জয়ের মাধ্যমে সমগ্র ব্রহ্মা দেশটির ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভুক্ত হয়।

(৪) ইন্দোনেশিয়া : জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিয়ো এবং বালির দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ইন্দ্রোনেশিয়া ইস্ট ইন্ডিয়াতে ওলন্দাজ প্রথম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ‌ওলন্দাজ বণিক শক্তি জাভা উপনিবেশের দখল নিয়ে প্রথমে সেখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে। পরে যাভা কে দখল করে ইন্দ্রোনেশিয়া অন্যান্য অঞ্চল গুলিকে ব্রিটিশ নিজের অধীনে আনে।

(৫) ইন্দ্রোচীন : অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদে ইন্দ্রচীন (কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম) এ ফরাসিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে নিজেদের করোদ রাজ্য গুলি হাতছাড়া হওয়ায় চীন ফ্রান্সের সঙ্গে সংঘর্ষনে লিপ্ত হয়। এ সংঘর্ষে হেরে গিয়ে ইন্দ্র চীনের ফরাসি আধিপত্য মেনে নেয়।

(৬) ফিলিপিনস ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ : ফিলিপিনস দ্বীপুঞ্জের ওপর স্প্রে নিজের কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রায় ২০০ বছর ধরে ফিলিপিসনে স্পেনের শাসন বজায় ছিল। ফিলিপপিশন বাসি স্পেনের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সেই সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। স্পেন কে হারিয়ে মার্কিনরা ফিলিপিনস দ্বীপপুঞ্জের দখল নেয়। পরবর্তী সময়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ টিও মার্কিন সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ।

৪. মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশ

উনিশ শতকে প্যারিস কে কেন্দ্র করে ইঙ্গ রুশ দ্বন্দ্ব বাধে। প্রথমদিকে প্যারেজে ইংরেজরা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, রেলপথ নির্মাণ, শিল্প কারখানা স্থাপন, শুক্লো গ্রহণ প্রবিধি সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে। পরবর্তীকালে এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা গুলি রাশিয়া ও দেওয়ার অধিকার করে প্যারিসবাসীকে নিজের অনুকূলে আনে। প্যারাসের সাহর আসিয়ার কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নিয়ে তার আজ্ঞাবহে পরিণত হন। এতে প্যারিস বাসি ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইঙ্গ রুশো কনভেশন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরের মাধ্যমে উভয় দেশ মিলিতভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। অতঃপর প্যারিসের উত্তরে রাশিয়া এবং দক্ষিণ ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

৫. নিকট প্রাচ্যে উপনিবেশ

নিকট প্রাচ্য অর্থাৎ তুরস্কর ছিল ইউরোপীয় শক্তিবর্গের কাছে এক লোভনীয় স্থান। রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া এই দুই দেশে দুষ্করের দখল নিয়োগে কেন্দ্র করে পারস্পরিক সংঘর্ষ লিপ্ত হয়। ইতিপূর্বে ইংল্যান্ডের দুষ্করের অখন্ডতা বজায় রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও রুশক কনভেশন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইংল্যান্ড ও দুষ্করকে গ্রাস উদ্যত হয়। ক্রিমিয়াযর যুদ্ধে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে পর তুরস্কের রুশো অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

৬. মধ্য এশিয়ায় উপনিবেশ

রুশো শক্তি তুরস্কে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ এবার মধ্য এশিয়ার দিকে ধাবিত হয়। রাশিয়ার এই অগ্রগতিকে ব্রিটিশ শক্তি ভারতে তার উপনিবেশ রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে প্রথম ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ ও দ্বিতীয় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ ইঙ্গ আফগান যুদ্ধের মাধ্যমে আফগানিস্তানের ব্রিটিশ প্রভাব দেখা দিলেও সেখানে অধিপত্য গড়ে ওঠে। তাই ব্রিটিশের ভাইসরয় লিটন আফগানিস্তানের সেনা অভিযান ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে চালান। কিন্তু আফগানিস্তানকে তিনি ব্রিটিশ ভারতের অঙ্গীভূত করতে ব্যর্থ হন। যদিও আফগান সূত্র ধরে খাইবার গিরিপথ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্তবর্তী কয়েকটি উপজাতির এলাকা ইংরেজদের অধিকারে আসে। অবশেষে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এক নিরপেক্ষ দেশ বাফার রাজ্য হিসেবে আফগানিস্তান স্বীকৃতি পায়। রাশিয়ায় তুরস্কের মার্ক অধিকার করে এবং হীরাটে অভিযান চালিয়ে মধ্য এশিয়ার নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার রীতি আবহতো রাখে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment