সূচনা : শুভ প্রাচীন কাল থেকে উপনিবেশিকতার ইতিহাস শুরু হয়েছে। প্রাচীন মিশর, পারস্য, ভারত, গ্রিসে এবং রোমানের শাসকগণ বিজিত দেশগুলি সঙ্গে উপনিবেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। বহুকাল পরে উনিশ শতক নাগাদ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকান বিস্তীর্ণ বৌভাত ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। মূলত ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইউরোপের শিল্প উন্নত জাতি গুলি উপনিবেশ দখলের জন্য উদ্মাত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন।
উপনিবেশ স্থাপনের কারণসমূহ
১. বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা
উপনিবেশ স্থাপনের অন্যতম একটি কারণ হলো বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা। উপনিবেশের অর্থনৈতিক সম্পদ, জনশক্তি ও তার ভূখণ্ডের আয়তন, সামরিক গুরুত্ব এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে উপনিবেশিক শক্তির মর্যাদা বা গুরুত্ব ও নির্ধারিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশিক গুলি নিজেদের অধীনে এনে বৃহৎ শক্তি হিসেবে মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ইউরোপীয় দেশ গুলির পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এই প্রতিযোগিতায় নৌ শক্তিধর ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্রগুলি এগিয়ে যায়। বৃটেনের এই রাষ্ট্রশক্তি হয়ে ওঠার আড়ালে তাদের সুবিশাল উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এশিয়ার মধ্যে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হওয়ার এখানে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় শক্তি বাণিজ্য করতে আসে। ভারতের অফুরন্ত সম্পদের লোভে প্রলুব্ধ হয়ে ব্রিটিশরা এখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে। এইভাবে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশগুলির উপনিবেশ গঠনের মধ্যে দিয়ে বৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করে।
২. উদ্বৃত্ত মূলধন
শিল্পোন্নত দেশ গলিতে মূলধনী শ্রেণী নতুন নতুন শিল্প মূলধন লগ্নীর দ্বারা মুনাফা পাহাড় উদ্বৃত্ত মূলধনের সৃষ্টি করে। এই উদ্বৃত্ত মূলধন দেশের বাইরে কোন শিল্পের লগ্নী করে আরো মুনাফা অর্জনের জন্য মূলধনী শ্রেণী সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এই লক্ষী তারা নিজে নিজে সরকারকে উপনিবেশ দখলের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। মূলধনের স্থিতি পরোক্ষভাবে উপনিবেশবাদ উত্থানের প্রেক্ষাপট রচনা করে। এক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লব ও ধনতন্তবাদ উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি করে।
৩. পুঁজিবাদের প্রসার
পুঁজিবাদের পোশাক ঘটানোর প্রচেষ্টায় বেশ কিছু উপনিবেশ গড়ে ওঠে। বিশেষত আধুনিক উপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের পদ প্রস্তুতি করার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের প্রসার বিশেষ করে সাহায্য করেছে। ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্প বিপ্লবী ঘট দিয়ে যাওয়ার পর পুঁজিবাদী অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়ে। বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে পুজির বিনিয়োগ শুরু হয়। দেশের মধ্যেকার নানা শিল্প ক্ষেত্র ছাড়াও বিদেশে লাভজনক ক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়োগ প্রচেষ্টা দেখা দেয়।
পুঁজিবাদের এই সুষ্ঠু প্রসারে জন্য উপনিবেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে, আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির শেষ কথা হলো অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জন। এই অধিকার মুনাফা অর্জনের তাড়নায় দেশের সীমারেখা এই অধিকার মুনাফা অর্জনের তাড়নায় দেশের সীমারেখা ছাড়িয়েও বিদেশের মাটিতে পুঁজিবাদের প্রসার ঘটে। এই পূঁজিকে দীর্ঘকালীন মেয়াদে বিলগ্নীকরণের জন্য উপনিবেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
৪. সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা
সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা থেকে উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। অনেক সময় অধিকৃত অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য উপনিবেশের জনগণের দাঁড়ায় সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়েছে। দখলেকৃত অঞ্চলের জনগণকে দমন করার কাজে বা সেই অঞ্চলের সম্পদ শোষণ করার কাজে এই সমর বাহিনীর ব্যবহার করা হয়েছে। সামরিক সুযোগ-সুবিধা কথা বিবেচনা করে জিব্রাল্টার প্রণালী, সুয়েজ কাল সন্নিহিত অঞ্চলের সিঙ্গাপুরের উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে।
নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির লোককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরী অঞ্চলের প্রাধান্য বিস্তার করেছে। মরক্কো তিউনিসিয়া বাসি উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম দমনের জন্য ইন্দ্রোচিন ফরাসি বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। আবার ইন্দ্রোচীনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে দমনের জন্য মরক্ক এবং তিউনিসিয়া সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ফরাসি উপনিবেশিক সরকার। সামরিক কারণে বৃটেনে সারপ্রাসে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। আসলেই অঞ্চল থেকে সহজেই মধ্যপ্রাচ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব ছিল।
৫. কাঁচামালের আমদানি এবং উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি
শিল্প বিপ্লবের কল্যাণী ইউরোপীয় দেশগুলির শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। বিভিন্ন ধরনের শিল্প পণ্য উৎপাদনের জন্য অফুরন্ত কাঁচামাল যোগানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রিয়ের জন্য শুভ বৃহৎ বা আন্তর্জাতিক বাজারের ও দরকার পড়ে। এই উভয় চাহিদা মেটানোর জন্য ইউরোপ দেশগুলোর উপযুক্ত উপনিবেশ সন্ধান শুরু করে। ইউরোপীয় দেশগুলি নিজস্ব উৎপাদিত পণ্যের বাজার এবং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে। আসলে নামমাত্র দামে কাঁচামাল জোগাড় করা এবং অনেক বেশি দামে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মেতে ওঠে।
নয়া উপনিবেশবাদের কুফল সমূহ
নয়া উপনিবেশবাদের বেশ কিছু কুফল লক্ষ্য করা যায়, যথা –
১. শোষণ
নয়া উপনিবেশবাদব বৈদেশিক ঋণ, সামরিক অস্ত্র, বাণিজ্য, সংস্কৃতির আদান-প্রদান, বহু জাতি সংস্থার মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে শোষণ করে চলেছে। উপনিবেশ বণিকের সার্বিক শোষণ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অনেক সময় বহুজাতিক সংস্থাগুলি অনুপ্রবেশ ঘটায়।
২. অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ
উন্নত দেশগুলির অনুন্নত দেশগুলোকে ঋণ দেওয়ার সময় নানা রকম শর্ত আরোপ করে। এই সমস্ত শর্তের দ্বারা ঋণ বহনকারী দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি সেখানকার বাণিজ্য শুক্লো হারো ঋণ দানকারী দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শুধু তাই নয় ঋণ গ্রহণকারী দেশের বিদেশ নীতির প্রণয়ন ও রূপায়ণীয় ঋণদানকারী দেশগুলি প্রভাব ঘটায়।
৩. সরকারি
নব উপনিবেশবাদী শক্তি দিন গ্রহণকারী দেশের সরকার কেউ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তৎপর হয়ে ওঠে। উপনিবেশবাদি শক্তির বিরুদ্ধাচরণকারী সরকারকে কুখ্যাত করে তার বদলে কার্যত পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে। নিজেদের স্বার্থ মত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই পুতুল সরকারকে পরিচালনা করে। এই সরকার কোন স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃত অর্থের সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সাহায্য প্রদানের অছিলায় এই সমস্ত দেশের নয়া উপনিবেশবাদ কায়েম হয়।