আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি (Methods of Modern History Writing) আলোচনা করো?

সূচনা : জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো ইতিহাসে নিজস্ব লিখন পদ্ধতি রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় সাক্ষ্য বা প্রামান্ন তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দ্বারা ঐতিহাসিক ইতিহাস রচনা করে থাকেন।। আমাদের চারিদিকে নানা ঐতিহাসিক উৎস ও তথ্যের সাহায্যে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বেশ কিছু নিয়ম নীতি মেনে ঐতিহাসিক ইতিহাস লেখেন। মার‌উইক-এর মতে, “প্রকৃত ইতিহাস লেখেন দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতোই কঠিন কাজ।”

আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি

ইতিহাস রচনা করতে গেলে ইতিহাসকে যে সমস্ত পদ্ধতি মেনে এগোতে হয়, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

১. উৎসর অনুসন্ধান

ইতিহাস লিখন পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হলো ঐতিহাসিক ঘটনার উৎস অনুসন্ধান করা। ইতিহাস হলো উৎস ভিত্তিক, উৎস ছাড়া ইতিহাস হয় না উৎস আবার নানা ধরনের হয়ে থাকে। যথা-

(১) প্রত্নতাত্ত্বিক : জীবাশ্ম, যন্ত্রপাতি, হাড়গোড়, অস্ত্রশস্ত্র, আসবাব পত্র, স্মৃতিসৌধ, স্থাপত্য প্রভৃতি।

(২) মৌখিক : মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্ম প্রচারিত ধর্মীয় বিশ্বাস, পৌরাণিক কাহিনী, অতি কথন, রূপকথা, কিংবদন্তি, কাহিনী মালা, পালা গান, প্রবাদ প্রকৃতি।

(৩) ছবি ভিত্তিক : চিত্রকলা, নকশা, মানচিত্র প্রকৃতি।

(৪) লিখিত বিবরণমূলক : প্রাচীন পান্ডুলিপি, দিনলিপি, চুক্তি বা সন্ধিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, সংবাদপত্র, মুদ্রিত পুস্তক প্রভৃতি। এই সমস্ত উৎস গুলি থেকে ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় উৎসের অনুসন্ধান করেন এবং সেগুলি সাহায্যে ইতিহাস রচনা করেন।

২. উৎস থেকে তথ্য চয়ন

উৎসের অনুসন্ধান শেষে ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় উৎস টি চিহ্নিত করেন। এই উৎস থেকে ঐতিহাসিক তার প্রয়োজনীয় তথ্য বলি সংগ্রহ করেন। উৎসের মধ্যে কার তথ্য গুলির গুরুত্ব ইতিহাসিক এর কাছে আলাদা হয়ে থাকে। কোন তথ্য অতিপ্রয়োজনীয়, কোনোটা আবার মোটামুটি প্রয়োজনীয়, আবার কোন তথ্য ঐতিহাসিকের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। ঐতিহাসিককে এই প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী উৎস থেকে তথ্য চান করতে হবে। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুযায়ী তথ্যগুলি শ্রেণীবিভাগ করে থাকেন।

শ্রেণীবিভাগের পর তথ্য গুলি পাঠ করে ঐতিহাসিক তথ্যের বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভের চেষ্টা করেন। ঐতিহাসিক ও ইতিহাসের তথ্য একে অপরের পরিপূরক। আসলে ইতিহাস হল-ঐতিহাসিক ও তথ্যের মধ্যে পারস্পরিক অবিচ্ছিন্ন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া এবং বর্তমান (ঐতিহাসিক) ও অতীত (তথ্য) উভয়ের মধ্যকার এক অন্তহীন সংলাপ।

৩. তথ্যের যাচাইকরন

ঐতিহাসিক তথ্য গুলি গ্রহণ করার পর সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে সেগুলি যাচাই করে থাকেন। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কে দুটি কাজ করতে হয়। প্রথম কি হলো তথ্যের বাহিক্য সমালোচনা, আর দ্বিতীয়টি হল তথ্যের অভ্যন্তরীণ সমালোচনা। বাহিক্য সমালোচনা দ্বারা তথ্যের জালিয়াতি বা প্রকৃত রূপ মৌলিকত্ব যাচাই করা হয়। অনেক সময় লিপিকার, নকল-নবীশ অনুবাদকদের গাফিলতির জন্য ঐতিহাসিক উৎসের তথ্য গুলি ভুলভ্রান্তি রয়ে যায়। বাইক ও সমালোচনার দ্বারা এই সমস্ত ভুলভ্রান্তি গুলোকে খুঁজে বের করতে হয়।

তথ্য যাচাইয়ের দ্বিতীয় ধাম হিসেবে অভ্যন্তরীণ সমালোচনার দ্বারা ঐতিহাসিক ও গৃহীত তথ্যের অন্তর্নিহিত ভাবদর্শ ও প্রেরণা সম্বন্ধে নিশ্চিত হন। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তার গবেষণা দিন জনগোষ্ঠী ধ্যান-ধারণা, যুগধর্ম, উটসের ভাষা প্রভৃতিকে নিজের আয়ত্তে আনেন। মোট কথা, ঐতিহাসিকের সেই তথ্য বা উৎস প্রণেতার আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থান এবং তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয়। তা না হলে তথ্য বা উৎসের সঠিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সম্ভব হয় না।

৪. তথ্য সমূহের বিশ্লেষণ

ইতিহাসবিদ প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই করার পর সেগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে থাকেন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসের তথ্য সূত্রগুলি কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হয়। কোন বক্তব্য প্রামাণ্য তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে সেই তথ্যকে সত্য বলে গ্রহণ করা যায়। ঐতিহাসিকের গ্রহণ করা বেশ কিছু তথ্যের ব্যক্তি নিরপেক্ষ, যেমন- পুরা তাত্ত্বিক তথ্য, মুদ্রা, প্রাচীন সাহিত্য, সভ্যতার ধ্বংসাবশে ইত্যাদি। এগুলি হল বাস্তব সম্মত ঐতিহাসিক তথ্য। আসলে ঐতিহাসিক পরীক্ষিত ও প্রমাণিত তথ্য কে নিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেন। তথ্য থেকে ঐতিহাসিক সত্য আবিষ্কার করেন আর সেগুলোকেই তার লেখায় ফুটিয়ে তোলেন। তোদের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে করে থাকেন। আসলে আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইতিহাসের ব্যাখ্যা আলাদা আলাদা ভাবে উপস্থাপিত হয়।

৫. ঘটনা ও বক্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন

দুটি ঘটনা বা বক্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিক তার লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই সম্পর্কে স্থাপনের প্রচেষ্টা আসলে ঐতিহাসিকদের সত্য রক্ষার নীতি বলা চলে যা মূলত চারটি উপদানের মিলিত রূপ যথা-করসপডেন্স থিয়োরি, কোহেরেন্স থিয়োরি, অথরিটি ও মেমরি। করসপডেন্স থিওরি দিয়ে সত্যের সঙ্গে তথ্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোহেরেন্স থিওরির দ্বারা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে ঐতিহাসিক সত্য পৌঁছানোর চেষ্টা করে থাকেন। অথরিটির ধারণা আসলে পূর্ববর্তী লোকের লেখাকে সত্য বলে গ্রহণ করা, যেমন – থুকিডিডিস বাসি রাত যা লিখেছেন সেগুলি বিনা প্রশ্ন গ্রহণ করা আর সময়কালে ঘটনা প্রত্যক্ষণকারীরা তার অভিজ্ঞতা যেভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখেন তা হল স্মৃতিবদ্ধ ইতিহাস বা মেমোরি। এই চার ধরনের ঐতিহাসিক সত্যের আলোকে ইতিহাসবিদ্যার লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যান।

৬. ধারাবাহিক ও কালানুক্রম

ধারাবাহিক ও কালানুক্রম ইতিহাস রচনা পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানুষের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের স্থান পায়। আর মানুষের প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ। যেকোনো ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সেই ঘটনার সময়কাল উল্লেখ করেন। কালক্রম অনুসারে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি কে তিন পর্বে ভাগ করে আলোচনা করেন, যথা-(১) ঘটনার সূচনা পূর্ব বা প্রাথমিক অবস্থা; (২) ঘটনার প্রকৃতিগত বা মধ্যবস্থা ; (৩) ঘটনার পরিণতি বা শেষ অবস্থা।

৭. কার্যকারণ পদ্ধতি

ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার লিখেছেন, ইতিহাস চর্চার মূল কথা হলো ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা। প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক ঘটনার কার্যকরণ ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসের রচনা পদ্ধতিতে কার্যকারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান আবশ্যিক। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র দৃশ্যমান বা সহজে বোঝা যায় এমন কারণ অনুসন্ধান নয়, পাশাপাশি ঘটনার গভীরে লুকিয়ে থাকা কারণ খুঁজে বের করে তার সঠিক উপস্থাপনা দ্বারা ঐতিহাসিক তার লেখাকে পূর্ণতা দেন। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কারণের অনুসন্ধান করতে হয়। ইতিহাসের সংঘটিত কোন ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণের জন্য প্রতিটি ঘটনাকে আলাদাভাবে জানতে হয়। এরপর প্রতিদিন ঘটনা ঘটার কারণ কি নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করতে হয়।

৮. ভৌগলিক অবস্থানের উল্লেখ

ইতিহাসের সব ঘটনা কোন ক্ষুদ্র বা বৃহৎ ভৌগোলিক স্থানের সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই যথার্থ ইতিহাস রচনার জন্য উৎস ও ঘটনার ভৌগোলিক অবস্থানের উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরি।

৯. তথ্য সংরক্ষণ ও ইতিহাস রচনা

ঐতিহাসিক কে তার ইতিহাস রচনা শুরু করার আগে প্রয়োজনীয় তথ্যের সংরক্ষণ করতে হয়। উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং সেগুলি সঠিকভাবে যাচাই করে নেবার পর ঐতিহাসিক যথার্থভাবে তথ্যগুলির সংরক্ষণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে তিনি তথ্যগুলি সংগ্রহ করে প্রথমেই তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে বা নোটবুক লিখে রাখেন। ইতিহাস লেখার সময় প্রয়োজন অনুসারে এই তথ্যগুলি তিনি ব্যবহার করে থাকেন। ঐতিহাসিককে ততগুলিকে এমন ভাবে সংগ্রহ করতে হয় যাতে ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য ভাবে তথ্যগুলির মধ্যে এক ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। তথ্য সংরক্ষণ ও প্রয়োগের সময় ঐতিহাসিক বিজ্ঞানের দৃষ্টি নিয়ে আকারের বিচার করবেন, আবার সাহিত্যিকের দৃষ্টি নিয়ে তিনি ইতিহাসকে সুখ পাঠ্য করে তুলবেন। ইতিহাস লিখন পদ্ধতির ওপর আলোচনা প্রসঙ্গে আর. জি. কলিংউড লিখেছেন অতীতে অনুসন্ধান বা ঐতিহাসিকের চিন্তাভাবনা ইতিহাস দর্শন নয়। এদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করাই হলো ইতিহাস দর্শন

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment