সূচনা : লোক সাহিত্যের এক বিশেষ অঙ্গ হলো লোককথা। লোককথা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের গল্প। লোক সমাজে প্রচলিত লোক কথার শ্রেণীভেদ বা রুপভেদ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ঐতিহাসিক গবেষকদের ধারণা অতীত থেকে মৌখিক ঐতিহ্য হিসেবে লোককথা বিভিন্ন রূপে প্রচারিত হয়েছে। সংস্কৃতি নৃবিজ্ঞানী ঐতিহাসিক ও লোকসংস্কৃতি গবেষকদের প্রচেষ্টায় লোক কথাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
লোককথার শ্রেণীবিভাগ ও সেগুলির ব্যাখ্যা
সাধারণভাবে লোক কথা কে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা রূপকথা, পরি কথা, পরশু কথা, কিংবদন্তি, লোক পুরান বা মিথকথা, নীতিকথা, গীতিকথা, ব্রত কথা। নিচের সংক্ষেপে সেগুলি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
১. রূপকথা
(১) আত্মপ্রকাশ : উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রূপকথার মধ্যে দিয়েই লোকসাহিত্যের লিখিত রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে গ্রীম ভাইয়েরা রূপকথার প্রথম লিখিত সংরক্ষণ প্রথম খন্ড প্রকাশ করে রূপকথার পরিচয় ঘটান।
(২) মর্মার্থ : জার্মান ভাষায় ‘মারচের্ন’ কিংবা সুইডিশ ভাষায় ‘সাগা’ রূপকথার মর্মার্থ প্রকাশ করে। এছাড়াও ইংরেজি ‘ফেয়ারি টেল’, জার্মান ম্যর্শেন, রুশিয়া ‘স্কাজঈ’ এবং ফিনীয় ‘সাগেন’ হলো রূপকথার সমধর্মী।
(৩) চরিত্র : রূপকথার চরিত্রগুলো সাধারণত কাল্পনিক হয়ে থাকে। রূপকথার বর্ণিত কয়েকটি চরিত্র হলো রাজা রানী, মন্ত্রী-কোটাল, রাজপুত্র-রাজকন্যা, দাস-দাসী, রাক্ষস-দৈত্য-ডাইনি-জাদুকর, পেত্নী প্রভৃতি। এছাড়াও রূপকথায় থাকে বেঙ্গমা-ব্যঙ্গমি, পক্ষীরাজ ঘোড়া, শকুন পাখি এবং কিছু কল্পিত পশু।
(৪) কাহিনী : রূপকথার কাহিনী বিশ্লেষণে দেখা যায় রূপকথার নায়ক বা নায়িকা সাধারণত কঠিন ও দুরহ কাজকে অতি সহজে সম্পন্ন করে সাফল্য পায়। অনেক সময় জাদুশক্তি সম্পন্ন কোন বস্তু বা ব্যক্তি সাহায্য নিয়ে রূপকথার কেন্দ্রীয় চরিত্র তার প্রতিপক্ষ (রাক্ষস, ডাইনি প্রভৃতি)-দের পরাজিত করে। রূপকথাতে অতি লৌকিক কাহিনী পরিবেশিত হয়। রূপকথার কাহিনী অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমি, সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি, জাদু আংটি, জাদু বস্তুর ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া প্রভৃতি। রূপকথা নিয়তির এক অদৃশ্য ভূমিকা থাকে, যা কাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে ও কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
২. পরিকথা
(১) সংজ্ঞা : লোককথায় আলোচনায় পরিকথা এক স্বতন্ত্র বিষয়। যে পড়ি কাহিনী কে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বা মুখ্য ভূমিকা পালন করে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যায় অর্থাৎ যে লোককথায় পরীকে কেন্দ্র করেই কাহিনী আবর্তিত হয় তাকেই বলা হয় নির্ভেজাল পরিকথা।
(২) চরিত্র : পরি কথার কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো পরি স্বয়ং। পরীরা ভালো-মন্দ দু ধরনের হয়ে থাকে। পরীরা অপরূপ রূপবতী হয়, তারা সব সময় সাদা পোশাক পড়ে থাকে। তারা লজ্জাবতী ও বনীয় হয়। তারা কম কথা বলে এবং মানুষের সঙ্গে এড়িয়ে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। পরিচরিতের পাশাপাশি রূপকতার মত বেশ কয়েকটি অন্যান্য চরিত্রের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়।
(৩) কাহিনী : পরিকথায় পরীকে কেন্দ্র করে কাহিনী বিন্যাস হয়ে থাকে, তারা অলৌকিক কাজে সম্পাদনের দ্বারা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে থাকে। রূপকথার মতই পরি কথার কাহিনীরও শুরু এবং সমাপ্তি ও প্রায় একই ধরনের। পরীরা অশুভ ক্ষতিকারক দুষ্ট শক্তিদের পরাজিত করেন। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের রূপকথাগুলিতেই পরি কথার আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। বিদেশে দুটি জনপ্রিয় পরিকতা হলো ‘সিন্ডারেলা’ এবং ‘স্লিপিং বিউটি’ গল্প দুটি।
৩. পশুকথা
(১) পরিচিতি : পশুকে নিয়ে কল্পিত গল্পকে পশু কথা বলে। লোক কথার বিভিন্ন ভাগ গুলির প্রাচীনত্তের বিচারে পৌরাণিক কাহিনী (Myth)-র পরেই এর স্থান।
(২) চরিত্র : পরশু কথায় পশু পাখিদের বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলী তুলে ধরা হয়। পশু কথায় পশু, মানুষ, অতি লৌকিক প্রাণীর সব মিলেমিশে উপস্থিত হয়। ভবিষ্যৎ বলা শুকপাখি, কথা বলার বানর, উপকারী কুকুর, পন্ডিত শিয়াল, বোকা কুমি, র্ধূত শেয়াল, চটপটে খরগোশ, অকৃতজ্ঞ সাপ, উপকারী পাখি এরা সকলেই পশু কথার চরিত্র।
(৩) কাহিনী : নানা ধরনের অলৌকিক ও ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া-কলাপ এর মধ্যে দিয়ে পশু কথার কাহিনী বর্ণিত হয়। পশু কথার কাহিনীতে পশুর মানব পশু শুভল উভয় ধরনের দোষ গুণ ধরা পড়ে। পরশু কথার কাহিনীগুলি আকারে ছোট হয়। এর কাহিনীতে মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, হীনতা-ক্ষুদ্রতা, বীরত্ব-বুদ্ধি সবই পশু পাখির প্রতীক হিসেবে প্রকাশিত হয়।
৪. কিংবদন্তি
(১) পরিচিতি : ইংরেজি ‘লেজেন্ড’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো কিংবদন্তি। প্রাচীন সাহিত্য গুলিতে এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে – “পূর্বকালে বিশেষ কোন ভোট উৎসবে যখন কোন সন্ন্যাসী বা ধর্মগুরুর জীবন বৃত্তান্ত কথিত বা গীত হতো তখন তার নাম হয় কিংবদন্তি।” সাধারণভাবে বলা যায় ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রণে লৌকিক কথা সাহিত্যের রূপবিশিষ্ট লোক কাহিনী হল কিংবদন্তি।
(২) চরিত্র : কিংবদন্তি চরিত্রগুলি বীর মানুষের জীবনগাথা। কিংবদন্তি চরিত্র ত্যাগ-উদারতা, পরোপকার, মানবিকতা, শৌর্যবীর্যে প্রায় দেবতা হয়ে ওঠেন। অনেক সময় সন্ন্যাসী, ফকির যাজক বা কোন স্থান কিংবদন্তি চরিত্র হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকদের ধারণায় কয়েকটি কিংবদন্তির চরিত্র হলো- শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, গিলগামেস, হারকিউলিস, রবিনহুড প্রমুখ।
(৩) কাহিনী : কিংবদন্তি তে যে কাহিনী বর্ণিত হয় তা একদিন নির্দিষ্ট অঞ্চলে ঘটেছিল বলেই সেই এলাকার বহু মানুষ বিশ্বাস করে থাকেন। কিংবদন্তির কাহিনী সর্বদা আখ্যান নির্ভর হয় না। অনেক সময় ছোটখাটো কোন ঘটনা ওয়েতে স্থান পায়। বাস্তব কল্পনায় মিলেমিশে কাহিনী রচিত হলেও ক্ষীন ভাবে এতে ইতিহাসের সূত্র মেলে।
৫. লোকপুরান ও মিথকথা
(১) পরিচিতি : সৃষ্টির আদিকালে অপরিণত বুদ্ধির মানুষ যে সমস্ত ধর্মীয় অলৌকিক কল্পকাহিনী রচনা ও প্রচার করে তাকে লোক পুরাণ (Myth) বলে। লোক পুরাণ গুলি লোকসমাজের দ্বারা মৌখিকভাবে সুপ্রাচীন অতীত থেকে রচিত হয়ে আসছে। ‘Myth’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘Muthos’ থেকে।
(২) চরিত্র : লোক পুরানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো অলৌকিক দেব দেবীগণ। এতে কাহিনীর মূল চরিত্র ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপরে আরোপিত। মূল চরিত্রটি ঈশ্বরের অলৌকিক লীলা কাহিনী বা কর্মকাণ্ডে রূপকার।
(৩) কাহিনী : পৌরাণিক কাহিনীগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক। ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পূজা পার্থনা, ধর্মোৎসব-উপাচার ইত্যাদি ভিত্তিতে পৌরাণিক কাহিনী গড়ে ওঠে। বিশ্বসৃষ্টির রহস্য, দেবতা মানবের জন্ম, মহাপ্লাবন, দেবতা-দানব-মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা-পুনর্জন্ম-অবতার, স্বর্গ-নরক, পাপ পূণ্য সমস্ত কিছুই হলো এর বিষয়।
৬. নীতিকথা
(১) পরিচিতি : মানব সমাজের বিভিন্ন সামাজিক পারিবারিক নীতিগুলি দ্বারা যে লক্ষ কাহিনী বর্ণিত হয় তাকে বলা হয় নীতি কাহিনী। নীতিকথায় কোন উপদেশ প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপনা করা হয়। নীতি কথাতে খুব সংক্ষিপ্তভাবে মূলনীতি গুলি উল্লেখ থাকে। বিশেষত লৌকিক নীতি কথাগুলি এর মূল সুর।
(২) চরিত্র : নীতি কথাগুলির মূল চরিত্র বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরু যারা গল্প কথার মধ্যে দিয়ে নীতিবাক্য গুলি তুলে ধরেন। মোজেস, যীশু খ্রীষ্ট, হযরত মোহাম্মদ, ভীষ্ম, বুদ্ধদেব, রামকৃষ্ণ দেব প্রমুখ ধর্মগুরু বা ধর্মপ্রবক্তাগণ যুগে যুগে লৌকিক নীতি কথার সাহায্যে অনেক সময় তাদের ধর্মাদর্শ প্রচার করে গেছে।
(৩) কাহিনী : নীতি কথার কাহিনীগুলি শেষে সাধারনত উপদেশগুলির উল্লেখ থাকে। কেবলমাত্র উপদেশ, নির্দেশ বা আদেশ নয়, নীতিবোধের আদর্শই নীতি কথার মূল বিষয়। নির্দয়, দয়ালু, নিন্দুক, হিংসা পরায়ণ, উদার, ক্ষুদ্রচেতা, নিষ্ঠুর, সংকীর্ণমনা, পরোপকারী, হীনবুদ্ধি, ঝগড়ুটে, অন্যায়কারী, লোভী, দুষ্টু বুদ্ধি, কটুভাষী, কৃপণ, অপব্যয়ি, দাম্ভিক প্রভৃতি দোষ গুণ ভরা মানুষদের নিয়েই গড়ে উঠেছে নীতিকথার কাহিনী।
৭. গীতিকা
(১) পরিচিতি : ইংরেজ ‘ব্যালাড’ এর বাংলার প্রতিশব্দ হলো ‘গাথা’ বা গীতিকা। লোক কথার একটি অন্যতম অঙ্গ হলো গীতিকা। সুর করে নাটকীয় ভঙ্গিতে পাওয়ায় গল্পগুলি হল গীতিকা।
(২) চরিত্র : গীতিকা চরিত্র গুলির মূলত কথক ও গায়ক। কথোপ ও গায়কের মাধ্যমে যে সমস্ত চরিত্রগুলি বর্ণিত হয় সেগুলি মূলত আঞ্চলিক কিংবদন্তি বা সত্য কাহিনীভিত্তিক।
(৩) কাহিনী : গীতিকায় নিটোল কাহিনী থাকে। এই কাহিনীতে আঞ্চলিক ভাবনা, ভাষা, রীতিনীতি, পরব, পারিবারিক সামাজিক জীবন ও আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতি পরম্পরা ধরা পড়ে। গীতিকার কাহিনীর মধ্যে কোন অনাবশ্য ঘটনা অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনা থাকে না। গীতিকার কাহিনী দ্রুত বেগে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।
৮. ব্রতকথা
(১) পরিচিতি : ব্রত কথা বলতে আমরা লোক কথার সেই বিভাগকে বুঝি যাতে ব্রতের মধ্যে দিয়ে গ্রাম্য জীবনের নানা ধরনের আশা আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। ব্রতকথা দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা -শাস্ত্রীয় ব্রতকথা, মেয়েলি ব্রতকথা।
(২) চরিত্র : ব্রতকথা চরিত্রগুলি মূলত দেবদেবী কেন্দ্রিক। ব্রতকতা দুই ধরনের দেবদেবী দেখা যায়। যথা- শান্তশিষ্ট দেবতা ও রুষ্ট দেবতা। মানুষের দোষ গুণের অবিকল প্রতিরূপ হিসেবে গড়ে ওঠে এই সমস্ত দেবতার চিত্রগুলি। অনেক সময় রূপকথা বা পশু কথার চিত্রগুলি ওয়েতে স্থান পায়। ব্রতকথার চরিত্রগুলি অনেকটাই একঘেয়ে ও বৈচিত্র হীন।
(৩) কাহিনী : ব্রত কথা আর কাহিনীতে বিভিন্ন ধরনের লোক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, কামনা পূরণে লক্ষ্যে কুচ্ছ্রসাধন পালন, বিপদ মুক্তির উপায়, দেব দেবীর কৃপা লাভের উপায় এবং দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রভৃতি বিষয়কেন্দ্রিক কাহিনী বর্ণিত হয়। ব্রত কথা শোনার গুণ বর্ণনা এবং ব্রত পালনের বিধি নিষেধ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে ব্রতকথা কাহিনী সমাপ্তি ঘটে।