‘বৈষ্ণব কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর বিচারে যে নতুন মানদণ্ড উপস্থাপিত করলেন তা কতখানি গ্রহণযোগ্য বলে তোমার মনে হয়।

মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যকে কেন্দ্র করে উত্তরকালের কবি শিল্পীর চিত্রে জেগেছে নানা জিজ্ঞাসা। বৈষ্ণব কবিতা মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রেমকবিতা হলেও এর মধ্যে একই সঙ্গে দেবী চেতনা এবং মানবিক ভাবনা প্রোজ্জ্বল হয়েছে। বৈষ্ণব কবিতার ধর্মীয় নামাবলির আচ্ছাদন সরিয়ে দিলে তার মধ্যে আমরা মানবিক জীবন রসের প্রেমচ্ছবিকে সুস্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, বৈষ্ণব সাহিত্যকেন্দ্রিক কবি চিত্তে জেগেছে নানা জিজ্ঞাসা, নানা প্রবন্ধে, কাব্যে, কবিতায় তিনি বৈব কবিতার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এমনকি ভানুসিংহ ঠাকুর ছদ্মনামে বৈষ্ণব পদাবলিও রচনা করেছিলেন। বর্তমান প্রসঙ্গে কবিতাটির মধ্যে তিনি বৈষ্ণব পদাবলীর বিচারের নূতন যে মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন তা নির্ণয় করা।

বৈষ্ণব কবিদের আধ্যাত্মিক দর্শন সমীক্ষা করলে দেখা যায় মানবিক প্রেম সম্পর্কের মাধুর্যের ঐশ্বরিক লীলা অনুভব করতে চেয়েছেন। বৈষ্ণব পদাবলী তাই বাস্তবিক পক্ষে বাস্তব জগতের নরনারীর প্রেমচ্ছবি। বৈষ্ণব কবিরা অনুপ্রাণীত হয়েছিলেন মর্ত্যলোকের নরনারীদের প্রেমচ্ছবির আলোকেই। রাধিকার চিত্তদীন তীব্র ব্যাকুলতা তাঁর মানবিক প্রেম থেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বৈষ্ণব ধর্মে মানবীয় প্রেম সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করার চেষ্টা লক্ষ্য করে সীমা অসীমের মিলন তত্ত্বে বিশ্বাসী কবি আনন্দিত হয়েছেন। সোনার তরীর এই কবিতায় পরিণত বয়সে তিনি মহাজন পদাবলির তত্ত্বমূল্য অস্বীকার না করে ও মানবমূল্য তথা তত্ত্বনিরপেক্ষ কাব্যমূল্য বিচারে ও স্বরূপ আস্বাদনে আগ্রহী। তাই, পদাবলির প্রেমচ্ছবির আড়ালে রয়েছে বাস্তব জগতের প্রেমচ্ছবি। প্রেমার্ত মানুষ স্বর্গ চায় না। শোকহীন হৃদয়হীন সুখ স্বর্গভূমি মানুষের দুঃখে উদাসীন, তার মানবিক দুর্বলতায় উদাসীন। মানুষ স্বর্গের দেবতাদের নয়নে অশ্রু দেখতে চায়। তাদের মুখচ্ছবি সুখ দুঃখের চঞ্চলতায় কখনও বিচারপ্রাপ্ত হয় না। কিন্তু পদাবলিতে—“রাধিকার চিত্তদীর্য তীব্র ব্যাকুলতা আছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয় রাধিকার প্রেম তথা বৈষ্ণব কবির। চুরি করে নিয়েছেন মানুষের সুখ মানুষের চোখ থেকে—মানুষের জীবন থেকে, মনে হয় যেন ‘স্বর্গ হতে বিদায় নিয়েছে বৈষ্ণব গান—মর্ত্যপ্রেমের ধূলি লেগেছে তাতে।

‘বৈষ্ণব কবিতা’ আমাদের হৃদয় মনকে গভীরভাবে করেছে আকৃষ্ট। এই আকর্ষণের মূলে দৈবী প্রেমানুভূতি নেই, আছে মানবিক প্রেমানূভূতি। কবিতাটি বাস্তবিক পক্ষে মানবিক প্রেমের গান। এ কবিতায় দেবদেবীর অপার্থিব প্রণয় চিত্ত ও মানব-মানবীর পার্থিব প্রণয় চিত্ত দুই-ই আছে, কবি দেবী ভক্তিগীতি হিসাবেই রচনা করেছেন এ কবিতা, মর্ত্য প্রেমগীতির রূপেও এ কবিতা পরিকল্পিত। আসলে কবি রবীন্দ্রনাথ যেন বিশ্ব নিসর্গলোকের সৌন্দর্যের মধ্যে এখানে অনন্ত বৃন্দাবন, প্রেমের চিরন্তন হৃদয়লীলাকে অনুভব করেছেন। তাই সমালোচক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “বৈষ্ণব কবিতা আমাদের মনকে যে এত মুগ্ধ করে তাহার করুণ ইহা নহে যে তাহার মধ্যে এই মর্ত্যের মানবীয় প্রণয়ের নানা লীলা সুন্দরভাবে দেবতার বেনামীতে প্রকাশ পাইয়াছে। আমাদের কবি স্বর্গ ও দেবতাকে মর্ত্য হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখেন নাই, তিনি মর্ত্যে অবতীর্ণ স্বর্গকে ও মানবীয় ভাবের মধ্যে পরিস্ফুট দেবভাবকে কল্পিত স্বর্গ ও দেবতা অপেক্ষা অধিক সমাদর করিয়াছেন।”

কবি বলেছেন যে মানব সব স্নেহ প্রেম রহস্য ময়েরই পূজা—“যারা বলে ভালোবাসা তারে বলে পূজা।” ভালোবাসা মাত্রই আমাদের মধ্যে বিশ্বজগতের অন্তরস্থিত সৃজনী ও পাশনী শক্তির আবির্ভাব। যে নিত্য আনন্দ নিখিল জগতের মূলে, সেই আনন্দের ক্ষণিক ও আংশিক উপলব্ধি হয় পার্থিব মানবীয় প্রেমে। বাস্তব প্রেমের মধ্যেই দেবত্ব নিহিত আছে, প্রেমকে বাস্তব ক্ষেত্র হতে সরিয়ে অপ্রাকৃতের মধ্যে স্থাপন করা যায় না। বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে অনন্ত ছন্দাবন বিরাজ করছে এবং তার মধ্যে চিরন্তন হৃদয়ের লীলা সংঘটিত হচ্ছে।

ফুটির কাননে নিত্য ফুল ফোটে। সেই ফুলে দেবতার চরণে অর্ঘ্যরূপে যেমন নিবেদিত হয় তেমনি দেওয়া হয় প্রিয়জনেও। বৈষ্ণব কবিরা যে প্রেমগীতিহার রচনা করেছেন তা শ্রীকৃষ্মে সমর্পিত হলেও—দেবচরণে প্রদেয় হলেও রসগ্রাহী মানুষ সেই প্রেমগীতিহারকে দেবচরণে না দিয়ে কণ্ঠে ধারণ করে থাকেন। ‘বৈষ্ণব কবিতার’ মধ্যে আমরা দেখি ভক্তি নিরপেক্ষ মানবিক আবেদনের দিকটি অত্যন্ত উজ্জ্বলরূপে পরিস্ফুট। আসলে বৈষ্ণব কবিতা যেন তটিনীর ন্যায়, প্রেম পরিধান নিয়ে সমুদ্রগামী নদীর মতো সে এগিয়ে চলেছে, যে যেমন করে খুশি তাকে গ্রহণ করে। দেবতা এবং প্রিয়জনের মধ্যে অভিন্নতার দিক যুক্ত করতে চেয়েছেন কবি। তাই কবি বলেছেন—

“এই প্রেম গীতিহার

গাঁথা হয় নরনারী মিলন মেশায়”

কেহ দেয় তারে, কেহ বধূর গলায় ৷৷ 

প্রিয়জনে-প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই 

তাই দিই দেবতারে ; আর পাব কোথা

দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই 

দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।”

বৈষ্ণব কবিতার মূল্যায়নে চূড়ান্ত সত্যের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে তাই জোরের সঙ্গে বলতে হয় এ কবিতা একাধারে দেবদেবীদের উপভোগ্য ভক্তিসংগীত এবং অন্যদিকে ধূলিধূসর ধরণির নরনারীর সংগীতরূপে স্বীকৃত।

বৈষ্ণব কবিতা লৌকিক চেতনার পথ ধরে রচিত হলেও শেষ পর্যন্ত অলৌকিক আনন্দানুভূতির জগতে উন্নীত। এখানে যে প্রেমচেনতার দিকটি উপলব্ধি করা যায় তা সীমা থেকে অসীম লোকের দিকের যাত্রা করেছে। বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য কাননের অনন্ত সৌন্দর্যকে রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় অনবদ্য রূপ দিয়েছেন, কবি মর্ত্য নরনারীর প্রেমচেতনার বৈকুণ্ঠ অভিমুখী যাত্রা প্রসঙ্গে ‘পঞ্চভূত’ গ্রন্থে বলেছেন—“যাহাকে আমরা ভালোবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই। এমনকি জীবের মধ্যে অনস্তকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা। প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করারই অন্য নাম সৌন্দর্য সম্ভোগ। সমস্ত বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে।” যখন দেখা যায় মা নিজের সন্তানের মধ্যে আনন্দের শেষ পায় না, সমস্ত হৃদয়খানি মুহূর্তে ভাঁজে ভাঁজে খুলে ওই ক্ষুদ্র মানবশিশুটিকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করে শেষ করতে পারে না। তখন নিজের সন্তানের মধ্যে নিজের ঈশ্বরকে উপাসঙ্গ করেছে। যখন দেখা যায়, প্রভুর জন্য ভৃত্য নিজের প্রাণ দেয়, বন্ধুর জন্য বন্ধু নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেয়। প্রিয়তম ও প্রিয়তমা পরস্পরের নিকট নিজের সমস্ত আত্মাকে সমর্পণ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তখন এই সমস্ত প্রেমের মধ্যে একটা সীমাতীত লোকাতীত ঐশ্বর্য অনুভব করেছে।

রাধাকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক প্রেম, পটভূমিকায়, ভক্ত ভগবানের প্রেমচিত্রের রূপকে এখানে বৈষ্ণব করিয়া কীভাবে মর্ত্যলোকের নরনারীর সাঙ্গীতিক দিককে সাথকভাবে হাজির করতে পেরেছেন তার সমর্থনী সুর ঝংকৃত করে সমালোচক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন : “বৈষ্ণব কবিতায় রবীন্দ্রনাথের তাই নবজাগ্রত জগৎপ্রীতির ও মানবপ্রীতি পূর্ণমাত্রায় ব্যক্ত হইয়াছে, বৈষ্ণব কবিতায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অপূর্ব কাব্যে ভাবে ও সংগীতে বর্ণিত আছে, বৈষ্ণব কবির এই অনবদ্য প্রণয়চিত্র মানবমানবীর প্রণয়, লীলার প্রতিচ্ছবি, পূর্বরাগ, মান অভিমান, অভিসার, বিরহ মিলন এই ধরণির নরনারীর প্রেমের অবস্থা ভেদমাত্র। রবীন্দ্রনাথের মতে “বৈষ্ণব কবিগণ এই মর্ত্যের প্রেমিক প্রেমিকার চিত্র দেখিয়াই স্বর্গের প্রেমিক প্রেমিকার চিত্র আঁকিতে পারিয়াছেন।”

বৈষ্ণব কবিতা বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য এখানে অলৌকিক প্রেমের স্বীকৃতি প্রদত্ত—বৈষ্ণব মহাজনরা এসব কথা বললেও রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিতার নবমূল্যায়ন করেছেন। তিনি ‘বৈষ্ণব কবিতা’ কবিতাটিকে এমনভাবে পরিবেশন করেছেন যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই কবিতাকে একই সঙ্গে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভক্তিগীতি এবং সাধারণ নরনারীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত মানবসংগীত রূপে লাভ করেছি, তাই সমালোচকের ভাবনা দিয়ে এ কবিতার সমাপ্তি টানা যেতে পারে- “একদিকে দেবভোগ্য ভক্তিগীতি, অন্যদিকে মানবগীতি।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment