‘সোনার তরী’ চিত্রগীতের অনন্য গঠনশৈলী’ ব্যাখ্যা করো।

১২৯৮ বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাসে শিলাইদহে কবিতাটি রচনা করেন। ৩০টি পঙক্তি, এর ৬টি স্বকে সজ্জিত এই কবিতায় এক অনন্ত বিষাদবাণী মর্ত্যভূমি ছেড়ে কোনও এক অজানাকে না পাওয়ার বাসনায় ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। কবিতার শুরুতেই আছে ‘কূলে একা বসি আছি, নাহিভরসা’, যা কবিতার শেষের ‘শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি’, সঙ্গে অসামান্য ভাবসঙ্গতি রক্ষা করেছে। মিশ্রবৃত্ত ছন্দে লেখা এই কবিতার প্রতিটি স্তবকে রয়েছে পাঁচটি লাইন। কবিতার ভাববিন্যাসের রূপকগত অর্থের নিরিখে একে আমরা পাঁচ পর্যায়ে ভাগ করতে পারি—

(১) খুব সাধারণ অর্থে এ এক বর্ষাতুর দিনে রোমান্টিক কবির কল্পনাবিলাসময় একাকীত্বের গীতিমূর্ছনা।

(২) আবার শ্রাবণে আকুলপদ্মায় ধানকাটা কৃষকের ঘরে ফেরার তাড়া শোনায় এ কবিতা। 

(৩) আরও গভীর অর্থ মানুষ তার সমগ্র জীবন ধরে কর্মের দ্বারা সোনার ফসল ফলায়। যা আমাদের জীবনে সভ্যতায় মরমে মরমে জড়িয়ে যায়। অথচ যখন সৃষ্টিকর্তা মানুষ ই চিরপ্রবাহের স্রোতে আশ্রয় পেতে চায় তখনই শোনে—“ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, চোটো সে তরী/আমারি (তোমারি) সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

(৪) রূপকের বহিরঙ্গের আবরণ সরিয়ে আরও পথ পেরোলে পাওয়া যায় চিরকালীন রবীন্দ্রবাণীর আস্বাদ। যে কথা কবি ‘মানসী’, ‘রাজা ও রানী’, ‘বিসর্জনে’ বলতে চেয়েছেন। খণ্ড দেহগত ক্ষণিক সৌন্দর্যের পিয়াসী কখনো আদর্শ প্রেম সৌন্দর্যের স্পর্শ পায় না। জীবনের মধ্যে জীবনাতীতের সন্ধান, সীমার মধ্যে অসীমের অনুভবের মধ্যে দিয়ে সার্থকতা কবিতার রূপক বিন্যাসে তা ভাস্বর হয়ে ওঠে—

  • সোনার তরী—বিশ্বের চিরন্তন, অখণ্ড ও আদর্শ সৌন্দর্য।
  • মাঝি—ওই সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
  • নদী—কালপ্রবাহ
  • কৃষক—মানুষ
  • ক্ষেত্র—জীবনের ভোগবহুল কর্মক্ষেত্র।
  • ধান—খণ্ড সৌন্দর্যের সঞ্চয়।

(৫) কবিতার পঞ্চম রূপকটি ভাস্বর হয়ে কবির শিল্পসৃষ্টির সময় চেতনা থেকে। কবি সোনার ফসল ফলিয়েছেন, তেমনি তাঁর ফসল যে সোনার তরীতে ঠাঁই পাবে তাও জানেন কিন্তু তিনি হতাশ এ যুগের সমালোচকদের বক্র সমালোচনায়৷ ‘আমি একলা’, ‘বাঁকা জল’, ‘ছোট ক্ষেত্র’ যেন তারই সমর্থন জানায়।

কবিতার সূচনা হয়েছে—“গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা”, বর্ষার চিত্রকল্পে। বর্ষা রবীন্দ্র কাব্যে শরীর পেয়েছে বহুবার। বর্ষা তাঁর প্রিয় ঋতু। এ ঋতু যেমন আগামী সম্ভাবনাকে আশ্বস্ত করে তেমনি ঘনিয়ে তোলে অনন্ত বিরহ। সমগ্র কবিতায় এ বিষাদ স্থায়ী হয়েছে, শেষ স্তবকের ব্যঞ্জনায়—“শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ গুরে ফিরে।” তারই সমর্থন৷ ‘রাশি রাশি’ ‘ভারা ভারা’, ‘কাটিতে কাটিতে’ প্রভৃতি শব্দদ্বৈতের মাধ্যমে কবি বর্ষাকালীন দীর্ঘ সূত্রতাকে কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। ‘ঘন বরষা’, ‘নাহি ভরসা’, ‘হল সারা’, ‘খরপরশা’, ‘এল বরষা’ প্রভৃতি উষ্ম ধ্বনির অন্ত্যমিল কবির বিষাদকে চরণে চরণে প্রসারিত করেছে।

কবিতার ছটি স্তবকে বিন্যস্ত হয়েছে পঞঞ্চ অংকের নাটক। শুরুতেই ঘনিয়ে এসেছে যার সংকট। জীবনের কর্মপ্রয়াসের পূর্ণতা না পাওয়ার ব্যঞ্জনা—“কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা”। দ্বিতীয় স্তবকে সংকট আরও ঘনীভূত—“এখানি তো ক্ষেত আমি একেলা।” তৃতীয় স্তবকে সংকট মুক্তির আশ্বাস আছে কিন্তু আশ্বাস দায়িনীকে তিনি চেনেন না— “গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!/দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে”। চতুর্থ স্বকে সরাসরি সংলাপে কবির মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে—“ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে ?” পরের স্তবকে যে উত্তর পেয়েছেন তাতে তিনি হতাশ—“আর আছে?” পশ্চিম অংকে তথা ষষ্ঠ স্তবকে ট্র্যাজেডির যবনিকা পতন ঘটেছে—“শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি/ যাহা ছি/ নিয়ে গেল সোনার তরী।”

পুরো কবিতাটি উত্তম পুরুষে লেখা, যা গীতি কবি রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতীক। ‘আমি একেলা’’, ‘ওগো তুমি কোথা যাও’, ‘আমারি’ প্রভৃতি শব্দ তার প্রতিকৃতিকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। প্রতিটি স্তবকের শুরু আর শেষের পঙক্তিগুলিতে এই গীতিরস মূৰ্চ্ছনা পেয়েছে র মাঝের পঙক্তিগুলির দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে অনন্য চিত্রকল্প। প্রথম স্তবকের প্রথমও শেষ লাইনে পাই—“গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’/’কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা’।

এর মাঝখানে ‘রাশি রাশি ভরা ভরা ধান কাটা হল সারা’/ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা।” অসাধারণ চিত্রকল্পময় বিন্যাস। দ্বিতীয় স্তবকে এই বিন্যাস আরও সুগঠিত। শুরু, শেষ লাইনের “ছোট খেত আমি একেলা”র মাঝখানে শব্দ চিত্রের পট অংকিত হয়েছে—“পরপারে দেখি আঁকা তরুছায়া মসীমাখা/গ্রামখানি মেঘে ঢাকা প্রভাত বেলা।” সবমিলিয়ে এ কবিত্র গীতের মেলবন্ধন রচিত হয়েছে।

কবি অলংকৃত বাকবিন্যাসে ধ্বনির প্রবাহকে সর্বব্যাপ্ত করেছেন তা যেমন শ্রুতিমধুর তেমনি ভাব ব্যঞ্জক। কয়েকটি অলংকারের নমুনাই যথেষ্ট—

  • অনুপ্রাস—গগনে গরজে মেঘ।
  • ব্যাচোৎপ্রেক্ষা—পরপারে দেখি আঁকা/তরুছায়া মসী মাখা।
  • সমাসক্তি—ভরাপালে চলে যায়, কোন দিকে নাহি চায় ৷ 
  • অতিসয়োপ্তি—“ঢেউগুলি নিরূপায় ভাঙে দুধারে।

কবিতায় অক্ষরবৃত্ত রীতিতে চরিত্র চরণান্তিক মিলবিন্যাসের যে ছন্দ আছে তা অর্থের প্রবাহকে স্তব্ধ তো করেই নি বরঞ্চ এর বিষাদময়তাকে পেলব মেদূর করে তুলেছে।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment