রবীন্দ্র কাব্যে যে দুই বিপরীতমুখী প্রবণতা আছে, কবি নিজেই সে কথার উল্লেখ করেছেন। বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবজীবনের সঙ্গে তাঁর গভীর আকর্ষণ তাঁকে বিশ্বের প্রত্যক্ষ জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান করে। কবি তাতে সাড়া দেন এবং কবিচিত্তের গভীরে প্রোথিত মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রীতিকে কাব্যসৃষ্টির মধ্যে প্রকাশ করেন। কিন্তু কবিচিত্তে আরও একটি গভীর আকাঙ্ক্ষা নিগূঢ় হয়ে আছে তা হচ্ছে নিরুপাধি সৌন্দর্যকে উপলব্ধির আকাঙ্ক্ষা। এই গভীর পিপাসা তাকে মর্ত্য-ধরণীর বন্ধন ছিন্ন করে কল্পনার পাখা মেলে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের আদর্শলোকের উদ্দেশ্যে অভিসারী হতে অনুপ্রেরিত করে। ‘সোনার তরী’ কাব্যেও কবিচিত্তের দুটি বিপরীতমুখী প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’, ‘যেতে নাহি দিব’ প্রভৃতি কবিতায় কবির প্রবল মর্ত্যপ্রীতি অভিব্যক্ত হয়েছে, আর কাব্যের শেষ কবিতা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় প্রবল হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা।
পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের অভিমুখে কবির যাত্রা স্বর্ণতরণীতে। সে তরণীর মোহিনী নাবিকার কাছে তিনি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছেন। প্রভাতে যাত্রারম্ভে কবির চিত্ত আশায় পূর্ণ ছিল, মনে হয়েছিল, ‘চঞ্চল আলো আশার মতন কাঁপিছে জলে।’ সহযাত্রিণী নাবিকার কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি না পেলেও তাঁর নীরব হাসিতে ভরসা পেয়েছিলেন।
তারপর অনেক সময় কেটে গেল, তরঙ্গক্ষুদ্ধ সমুদ্রের উপর দিয়ে কবি অনেক পথ অতিক্রম করে এলেন। কখনও নিরাশায় তিনি পীড়িত হয়েছেন, কখনও আশায় উৎসাহিত হয়েছেন। আশা-নিরাশায় আন্দোলিত চিত্তে তিনি বার বার প্রশ্ন করেছেন, জানতে চেয়েছেন পরপারে কি আছে। কিন্তু কোনও স্পষ্ট উত্তর মেলেনি, শুধু নীরব হাসিতে আশ্বাস পাওয়া গেছে।
এখন সূর্য অস্তাচলগামী, রক্তিম আলোকে আকাশ ও সমুদ্র রাঙা হয়ে উঠেছে। দিনাবসানের চিত্রটি অপূর্বভাবে আঁকা হয়েছে, প্রাকৃতিক চিত্রের সঙ্গে মিশেছে কবির নৈরাশ্যপীড়িত মানসিকতার কারুণ্য। রাত্রি আসন্ন কিন্তু কূলের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর নয়। কবি যেখানে পৌঁছাতে চান সেই নিরুপাধি সৌন্দর্যলোকের অস্তিত্ব সম্পর্কে কবিমনে তীব্র সংশয় জেগেছে। অন্ধকার গাঢ়তর হলে সঙ্গিনী নাবিকার মুখের হাসিটুকুও দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। তখন ভরসাহীন সংশয় কবির পক্ষে সহ্য করা শক্ত হবে।
কবি সমগ্র কবিতাটিকে পরিচিত জগৎ থেকে কোনও এক কল্পিত জগতে উত্তীর্ণ হওয়ার তীব্র বাসনা ব্যক্ত করেছেন। সেই বাসনা সংশয়ের মেঘে আচ্ছন্ন। একদিকে আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা, অপরদিকে সংশয় ও নিরাশার বেদনা কবিতাটিতে পরস্পর বিজড়িত হয়ে একটি অভিনব সমাবেশ সৃষ্টি করেছে। তবুও কোনো অজ্ঞাত জগতে পৌঁছাবার জন্য কবি ব্যাকুল; এই ব্যাকুলতাই কবিতাটির মূল সুর। পরিচিত জগৎ থেকে সুদূরে যাত্রার তীব্র আকাঙ্ক্ষাই এ কবিতাটির কেন্দ্রীয় ভাব। কবির কাম্য সেই জগতের প্রকৃত রূপ কি, তা কবির কাছে স্পষ্ট নয়। যদি তাকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের জগৎ বলা যায়, তবে প্রশ্ন জাগে যে সেই জগতকে আয়ত্ত করা সম্ভব কিনা। যা প্রত্যক্ষ নয়, সুপরিজ্ঞাত ‘নিরুদ্দিষ্ট’ বা ‘নিরুদ্দেশ’ জাতীয় শব্দ তার সম্পর্কেই ব্যবহার করা যায়। কবি তাঁর কল্পনার পরিপূর্ণ সৌন্দর্যজগৎ সম্পর্কে সঙ্গতভাবেই তাই ‘নিরুদ্দেশ’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন এবং এই যাত্রাকে ‘নিরুদ্দেশ’ নামে অভিহিত করেছেন। কবিতার কেন্দ্রীয় ভাববস্তু এই নামকরণে যথাযথভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর