এ জগতে কিছুই চিরস্থায়ী নয়, জন্মলাভ করলে মৃত্যু অনিবার্য। আমরা যতই নিবিড় ভালোবাসার বন্ধনে আমাদের প্রিয়জনকে বেঁধে রাখতে চাই না কেন, বিশ্বের অপ্রতিরোধ্য নিয়মে সে বাঁধনকে শিথিল করতেই হয়। জগতে তাই বেদনা জাগছে, মানুষের হাহাকার সারা বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটিতে যে উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছে তার মূলে মানবজীবনের এই করুণ দিকটি নিহিত হয়ে আছে, অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কবির এই ভাবটিকে অভিনব বলা চলে না। তবু এই পুরানো সত্য কবির কল্পনার রসে সঞ্জীবিত হয়ে যে মূর্তিতে প্রকাশ পেয়েছে, তার রসগত চমৎকারিত্ব আমাদের আবিষ্ট করে এবং এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে। কবিতাটি অভিনব মনে হওয়ার কারণে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে কবির উপলব্ধির বিশিষ্টতা এর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। মানবজীবনের একটা সাধারণ অভিজ্ঞতাকে কবি নতুন তাৎপর্যমণ্ডিত করে বিশ্বের পটভূমিতে স্থাপন করেছেন।
কবিতাটির শুরুতে একটি ঘরোয়া জীবনের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। পূজার অবকাশ অস্তে প্রবাসে যাত্রার জন্য প্রস্তুত গৃহস্বামীর যাত্রার আয়োজনে গৃহিণীর মমতার অভিব্যক্তি অতি সাধারণ দৃশ্যকে বেদনার রসে আপ্লুত করেছে। যাত্রার মুহূর্তে প্রবাস যাত্রী শিশুকন্যাটির কাছে বিদায় চেয়েছে। কি ভেবে কে জানে শিশুটি বলে উঠেছে, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়।’ এই স্নেহের দাবী এই সংসারে প্রতিনিয়তই উচ্চারিত হচ্ছে কিন্তু কর্তব্যের দায়ে এইসব হৃদয়ের দাবি তুচ্ছ হয়ে যায়। এ পর্যন্ত কবিতাটিতে অসাধারণত্ব কিছুই নেই, কিন্তু এরপর থেকেই কবিতাটিতে ভিন্ন সুর বেজে উঠেছে। কবিকল্পনা শিশুকন্যার গর্বিত স্নেহবাণীর প্রভাবে জেগে উঠে বিশ্বের মর্মগত এক বেদনার স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছে। কবিতার এই অংশে কবি প্রসারিত কল্পনায় সমগ্র বিশ্বকেই কাব্যের বিষয়ীভূত করেছেন। বসুন্ধরা মাতৃরূপে প্রতিভাত হয়েছে তাঁর কাছে যিনি স্নেহের বাঁধনে আপন সন্তানদের বেঁধে রাখতে চান—তৃণতরু থেকে জীব সমস্ত সবাই তাঁর সন্তান। কিন্তু কিছুই তিনি ধরে রাখতে পারেন না তাঁর সীমাবদ্ধ ভালবাসার ক্ষমতা দিয়ে। বিশ্বের বুকের ওপর দিয়ে প্রবাহমান প্রাণধারা ছুটে চলেছে প্রলয় সমুদ্রের দিকে। সেই গতি রোধ করার সাধ্য কারও নেই। স্নেহ ও প্রেমের বন্ধন যত বড়ই হোক মৃত্যুর কাছে তাকে পরাভব স্বীকার করতেই হয়। এই পরাভবের বেদনা সমগ্র বিশ্বের ওপর বিষাদ-কুয়াশার আবরণ বিস্তৃত করে দেয়। কবির দৃষ্টিতে মাতা বসুন্ধরা এক বিষাদময়ী মাতৃমূর্তিতে ধরা দিয়েছেন—যিনি সৃষ্টি করেন কিন্তু রক্ষা করতে পারেন না।
মানবজীবনের অতি সাধারণ দুঃখময় একটা ঘটনা দিয়ে শুরু কবিতাটি ক্রমে বিশ্বব্যাপী বেদনার বৃহত্তর ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই উত্তরণের সূত্রে কবিতার মধ্যে স্থান পেয়েছে বিশ্ব-প্রকৃতির দৃশ্য। সে দৃশ্যগুলি বেদনার রসে ভারাক্রান্ত। সংকীর্ণ অর্থে এ মানবজীবনের ট্র্যাজেডি নয়, এই ট্র্যাজেডিকে সমগ্র বিশ্বজীবনের মর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে কবি গভীরতর জীবন রহস্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। মানবজীবনের বিচ্ছেদ-বেদনা বিশ্বজীবনের পটে সংস্থাপিত হওয়ায় ব্যাপকতর ও মহত্তর তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে উঠেছে।
বিশ্বজগতে নিত্য প্রবহমানতা যেমন সত্য, স্থিতির আকাঙ্ক্ষাও তেমনি সত্য। স্নেহের প্রেমের সম্পদকে চিরকালের জন্য রক্ষা করবার আকাঙ্ক্ষা জীবনের সহজাত। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা কখনই পূর্ণ হয় না, গতির চলমানতার কাছে পরাভব স্বীকার করে। হৃদয়ের করুণ কোমল বাসনাগুলি যে প্রতিমুহূর্তে বিফল হচ্ছে, ভালোবাসার বন্ধন স্খলিত হয়ে যাচ্ছে, জীবনের এই বেদনার দিকটাই আলোচ্য কবিতায় বিশেষভাবে কবি-কল্পনার অবলম্বন। জগৎ ও জীবনের প্রবহমানতা ও পরিবর্তনশীলতার সত্যকে কবি অস্বীকার করেননি, কিন্তু তাঁর ভাবনা, কল্পনাকে আচ্ছন্ন করেছে গতির আঘাতে বিচূর্ণিত ভালোবাসার জন্য দুঃখবোধ। সেইজন্য সমস্ত বিশ্বকেই তিনি দেখিয়েছেন বিষাদাচ্ছন্নরূপে। বিশেষভাবে কবিতার শেষ অংশে বেদনাবিধূর শিশুকন্যার সঙ্গে বিষাদময়ী ধরিত্রীকে একাকার করে ফেলেছেন। মাতা বসুন্ধরার উদাসিনী বিষাদ-মূর্তির বর্ণনায় কবিতাটি সমাপ্ত হয়েছে। প্রকৃতির ওপরে মানবীয় ভাব আরোপের নৈপুণ্যের দিক থেকে কবিতাটি আশ্চর্য সফল। বিদায়মুহূর্তে শিশুকন্যার স্নান মুখখানির বিষাদময়তা কবি অনায়াসে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির ওপরে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। চিরদিনের পরিচিত পৃথিবী কবি-কল্পনার ভেতর দিয়ে নতুনরূপে প্রতিভাত হয়।
অপ্রতিরোধ্য নিয়তির আঘাতে কাতর শোকার্ত ধরিত্রীমাতার উদাসিনী মূর্তি পাঠকের চিত্তে গভীরভাবে মুদ্রিত হয়ে যায়। প্রাত্যহিক সংসার যাত্রার মধ্যেই বিশ্বজীবনের এক গভীর রহস্য প্রতিফলিত হয়। কিন্তু সংসারের অলঙ্ঘনীয় এই নিয়ম, মানবাত্মার এই চিরতর ট্র্যাজেডি কবিকে নৈরাশ্য ও নিস্পৃহতার দিকে কখনও ঠেলে দেয় নি। বরং এই কঠোর নির্মম অনুশাসনকে স্বীকার করেই এক তীব্র পৃথিবী-প্রেমই কবিতাটির প্রধান মর্মবাণী।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর