বীরাঙ্গনা কাব্যের ‘সোমের প্রতি তারা’ কবিতার কাব্যশৈলী বিচার করো।

সোমের প্রতি তারা পত্রিকাটি ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ২য় পত্রকাব্য। মধুসূদনের এই পত্রটি আঙ্গিকগত ভাবগত দিক থেকে বৈপ্লবিক। ভাবে মাইকেল এখানে বিপ্লব এনেছেন—নারীমুক্তি ও নারী স্বাধীনতার তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে। যদিও ‘তারা’ চরিত্রটি পুরাণ থেকেই উঠে এসেছে তবে এই তারার আত্মা গড়ে উঠেছে ঊনিশ শতকীয়া রেনেসাঁসের নারী জাগরণের পটভূমিকায়। আঙ্গিকে কবি এখানে বিপ্লব ঘটিয়াছেন তার Blank Verse বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের সুললিত মূৰ্চ্ছনায়।

ব্রষ্ম বৈবর্তপুরাণে তারার যে চরিত্র চিত্রণ দেখা যায়, মধুসূদনের সেই চিত্রকে পরিবর্তিত করে অঙ্কন করেছেন। পৌরাণিক কাহিনিতে বৃহস্পতি পত্নী তারার কোনো কলঙ্কের কথা নেই। সেখানে সোমদেব অর্থাৎ চন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতি আশ্রমে বিদ্যাধ্যয়ন করতে এসে তারার অসামান্য সৌন্দর্যে মোহিত হয়। পুরাণে চন্দ্রকেই চিত্রিত করা হয়েছে কামার্ত রূপমোহগ্রস্ত পুরুষ রূপে। গুরুপত্নীর প্রতি এরূপ মনোভাব ভারতীয় শাস্ত্রীয় বিচারে মহাপাপ সেখানে চন্দ্র তা বিস্তৃত হয়েছিলেন। তার প্রস্তাবে গুরুপত্নী তারা সোমকে ভর্ৎসনা করেছিলেন কঠোর বাক্যে কিন্তু পুরাণের তারার সঙ্গে মধুসূদনের তারার পার্থক্য বিস্তর। সেখানে সোমের প্রতি তারার কোনো ভৎর্সনার উল্লেখমাত্র নেই, বরং গুরুপত্নী হওয়া সত্ত্বেও তারার মনে জেগেছে মিলনের আকাঙ্ক্ষা, সোমকে “এখান তারাই” প্ররোচিত করেছে—

“এ নব যৌবন, বিধু অর্পিব গোপনে 

তোমায়, গোপনে যথা অর্পেণ আনিয়া

সিন্ধু পদে মন্দাকিনী স্বর্ণ, হীরা, মণি।”

অবৈধ, সামাজিক স্বীকৃতি হীন এই প্রেমের চিত্র মাইকেল চিত্রিত করেছেন অসম সাহসিতার সাথে।

এ পত্রটির সাথে অপর যে পত্রের সাদৃশ্যের কথা সহজেই মনে আসে তা হল ওভিদের কাব্যে অসংযত চরিত্রের যুবতী ফ্রেডা। ওভিদের কাব্য অসংযত চরিত্রের যুবতী ফ্রেডা তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে সপত্নী পুত্র ‘হিপ্পোলিটাস’কে এভাবে প্রেম নিবেদন করেছিলেন, মিলনের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ‘সোমের প্রতি তারা পত্রিকার এই ধরনের গোপন সমাজনিন্দিত প্রেমের কথা থাকলেও তা মুক্ত প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর সাহিত্যে ও সৌন্দর্যতত্ত্বের বিচারে এই মুক্ত প্রেমকে দৃপ্ত কণ্ঠে অকপটে প্রকাশ করবার মতো সাহস কম বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচায়ক নয়। আর এদিক থেকেই অশঙ্কিনী নায়িকা তারার পত্রিকা আমাদের কাছে চির আধুনিক।

এ পত্রিকায়, তারা চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে মধুসূদন তাকে যতটা পাশ্চাত্য উপাদানে গঠন করেছেন, ততখানি ভারতীয় নারীর আদর্শে গড়ে তোলেননি। তবে শেষ পর্যন্ত মাইকেল তাঁকে বাংলা ভাষায় নিপুণ আধারে স্থাপন করে, তাঁকে করে তুলেছেন স্বদেশের ঐতিহ্যে লালিত পরিপূর্ণ ভারতীয় নারী প্রতিমা। সোমের প্রকৃতি প্রেম প্রকাশের মধ্যেই রয়েছে তার ভারতীয় নারীর বিনম্রতা বোধ। একদিকে তারার মধ্যে রয়েছে ঘুমন্ত অতৃপ্ত প্রেম, যা গুরুগৃহে পাঠরত সোমকে কেন্দ্র করে আপনার প্রকাশপথ খুঁজে নিতে চেয়েছে অন্যদিকে তিনি সমাজে প্রচলিত তথাকথিত সতীত্বধর্ম লঙ্ঘন করে তাঁর হৃদয়ের নারীত্ব ধর্মকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়েছেন বলে তার মনে একটা অপরাধবোধ ও আত্মসচেতনতার বোধ ও কাজ করেছে পত্রের একেবারে প্রথম থেকেই। মধুসূদন অপূর্ব শৈল্পিক দক্ষতায় ‘পাপকথা’, ‘পরাধীন’, ‘ক্ষমিও দোষ’, ‘পাপীয়সী’, ‘পাপ প্রবাহিনী’ ইত্যাদি আত্মধিক্কার মূলক শব্দের একাধিক প্রয়োগে তারা চরিত্রের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু নিজেকে পাপীয়সী জানা সত্ত্বেও আত্মসচেতন তারা অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির জন্যই জীবন ধর্মের তাগিদে আর নারীর নারীত্বকে স্বামী সৃষ্টিশীলতা দেবার বাসনাতেই সোমের প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন এজন্যই সে বীরঙ্গনা। তাঁর নিষিদ্ধ প্রেম নৈতিক ও সামাজিক বাধার কারণেই ক্রমশ বেগবান হয়েছে। তারার কথোপকথনে ধাপে ধাপে পূর্বরাগের মাধুর্য্য, সম্পূর্ণ বিরুদ্ধতার সংকোচ ও লজ্জা ও পরিশেষে পরিণত প্রেমের রতি বিলাসের স্বপ্ন—এই পরিপূর্ণ চিত্রটি আমরা পেয়ে যাই। প্রেম তা যতই নিষিদ্ধ হোক না কেন, তাকে কেন্দ্র করে নারী মনস্তত্ত্বের ক্রমিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের এই যে স্বাভাবিক সঙ্কোচহীন চিত্রায়ণ কবি হিসেবে মাইকেলকে তা অবশ্যই আধুনিকতা দান করেছে, আর কাব্যটিও এতে শৈলীগত সূষমা ও সংহতি লাভ করেছে।

মোট ১৭টি স্তবকে তারা পত্রিকা সমাপ্ত হয়েছে। ‘বীরাঙ্গনা’র অন্যান্য পত্রের মতোই এটিতেও দেখি ড্রামাটিক মনোলগ-এর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার। কবি এই নাটকীয় একোক্তির ছাঁদকে অনেক জায়গাতেই সংলাপ আশ্রয়ী করে গড়ে তুলেছেন। ফলে কাব্যে নাটকীয় প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকায় কথক তারা—সেই পত্রকাব্যটির নায়িকা। কখনও কখনও তারার একোক্তি স্বগতোক্তির দিকে সরে যেতে চেয়েছে, এসব ক্ষেত্রে নায়িকা অন্তর্মুখী নিজের সঙ্গেই নিজের কথোপকথন চলেছে তার। আবার শেষের দিকে এই একোক্তিই রয়েছে সংলাপাশ্রয়ী, আর নায়িকা তখন বহির্মুখী ভূমিকার অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে কথোপথনের মগ্ন হয়েছে। যেমন—’হায় রে, অবোধ আমি! নারিনু বুঝিতে/সহসা এ সাধ কেন জনমিল মনে ?/কিন্তু বুঝি এবে বিধু!….তারার যৌবন-বন ঋতুরাজ তুমি ! কবি এখানে ‘সরণ’-এর মাধ্যমে সুকৌশলে স্বগতোক্তি থেকে সংলাপাশ্রয়ী বক্তব্যের দিকে সরে আসার চেষ্টা করেছেন। ‘সরণ’-এর এই ধরণটি স্পষ্টতা পেয়েছে প্রথম পঙ্ক্তির ‘আমি’ নামক সর্বনাম থেকে শেষ পক্তির ‘তুমি’ নামক সর্বনাম-এর উল্লেখ-এর মধ্যে দিয়ে।

কবি, নায়িকার কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই এপত্রে, কোথাও কোথাও বহুমাত্রিক চরিত্র সংযোজন ঘটিয়েছেন। স্বাভাবিক সংযোজন-এর এসেছে নায়িকা—অতিরিক্ত মনুষ্য চরিত্রগুলি, যাদের উদ্দেশ্য করে নায়িকা তার বক্তব্য প্রকাশ করেছে। এছাড়াও সংযোজিত হয়েছে মনুষ্যতর প্রাণী বা অচেতন পদার্থের সংযোজন। সেক্ষেত্রে নাটকীয় একোক্তি নির্মাণের কৌশল দেখে মনে হয়, এরাও যেন কাব্যে নায়িকার সঙ্গে কথোপকথনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। যেমন— ‘হে স্মৃতি….. আজি চাহে নিবাইতে তোমায় পাপিনী তারা! –এ বাক্যে তারা নিজের ‘স্মৃতি’-কে উদ্দেশ্য করে। উপস্থাপন রীতিতে তার সংলাপটি ব্যক্ত করেছে, তাতে ‘স্মৃতি’ নামক মনের একটি বিশেষ অতীত অবস্থাও মনুষ্য প্রাণীর মতো চারিত্রিক সজীবতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এ পত্রে।

নায়িকা তারা নায়ক সোমদেবকে বিচিত্র বিশেষণ ও অভিধার ভূষিত করেছে। একই চরিত্রকে এইভাবে একাধিক অভিধায় ভূষিত করবার প্রবণতা-কে শৈলী বিজ্ঞানের বলা হয় সমসূচক প্ৰয়োগ’। উদাহরণ থেকে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়। যেমন—

১. গুরুপত্নী আমি তোমার, পুরুষরত্ন

২. এসো তবে প্রাণসখে

৩. তারানাথ! তোমাদের ? কে তোমারে দিল এ নাম তারাদেবী এখানে নির্বিশেষ অভিধা ‘পুরুষরত্ন’ দিয়ে শুরু করেছেন। কিন্তু তারার সংলাপে অবচেতনভাবেই তার মনে উদ্ভুত নিষিদ্ধ প্রেমের বাহ্যিক প্রকাশ ঘটেছে ‘প্রাণসখা’ অভিধার মধ্য দিয়ে, অথচ সোমদেব এখানে নিছক সখা রূপে আহূত নন, তিনি যে তারার প্রেমাস্পদ তা বুঝতে পারা যায় ‘তারানাথ’ শব্দটির ব্যর্থ অভিধাসূচক ব্যঞ্জনায়। চন্দ্রকে বলা হয় তারানাথ কারণ তিনি নক্ষত্র সনাথ।

নায়িকা তারা সোমকে তার নিজের প্রাণনাথ হিসেবে চিহ্নিত করে পূর্বোক্ত এই ব্যাপারটিকে নিয়ে সুন্দর উক্তি করেছেন—

“তারানাথ ? কে তোমারে দিল

এ নাম? হে গুণনিধি, কহ তা তারারে!

এ পোড়া মনের কথা জানিল কি ছলে

নামদাতা ?

সংলাপকে বহুস্তরিক করে তুলতে কবি সংলাপের মধ্যে প্রয়োগ করেছেন ‘অন্তঃশায়ন’ নামক প্রকৌশল। এতে পত্রলেখিকার সংলাপের মধ্য দিয়ে সুকৌশলে কথক সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে কেবল পত্ররচয়িতাই একমাত্র কথক চরিত্র নয়, আরও অনেক কথক চরিত্র এসে উপস্থিত হয়। তাছাড়া, নায়িকার পত্র রচনার সময়টিকে ‘বর্তমান কাল হিসেবে ধরলে এই সংলাপকে আশ্রয় করে পত্রটিতে অতীত কাল ও বর্তমান কালের মেলবন্ধন ঘটে। যেমন—

প্রবেশিবে ফুলবনে, পাইতে চৌদিকে/তোলা ফুল। হাসি তুমি কহিতে, সুমতি,/“দয়াময়ী বনদেবী ফুল অবচয়ি,/ রেখেছেন নিবারিতে পরিশ্রম মম!”

এ অংশে উদ্দিষ্ট নায়ক সোমদেবই কথক। আর অতীত ঘটনা ও বর্তমান সময়কে একই প্রেক্ষাপটে দাঁড় করিয়েছেন কবি। তারার সংলাপ হিসেবে রয়েছে কিছু বিশেষ ভঙ্গির প্রশ্নবাক্য। যেমন—

‘কে সে মনঃচোর মোর, হায়, কেবা আমি !–

ভুলি ভূতপূর্ব কথা,—ভুলি ভবিষ্যতে!

এখানে প্রশ্নবাক্যই হয়েছে নায়িকার স্বগতোক্তির ভূমিকায় (যদিও এটি প্রত্যক্ষ প্রশ্ন নয়)। আবার, প্রশ্নবাক্যের বিস্তার ঘটেছে অপ্রাণীবাচক বস্তুকে কেন্দ্র করে। যেমন—‘কি লজ্জা! কেমনে তুই, রে পোড়া লেখনি, লিখিলি এ পাপকথা। সম্বোধন সূচক বাক্যের ক্ষেত্রেও দেখেছি, অপ্রাণীবাচক বিমূর্ত অবস্থা হয়ে উঠেছে সম্বোধন উপযোগী চরিত্র। যেমন—

“হে, স্মৃতি, কুকর্ম্মে রত দুৰ্ম্মতি যেমতি…..” এসব বৈশিষ্ট্যের নাটকীয় প্রত্যক্ষতা সৃষ্টি হয়েছে পত্রকাব্যটিতে।

এছাড়া ও ‘এ পোড়া মনের কথা জানিল কি ছলে’; ‘এ পোড়া মনে, পার কি বুঝিতে ? ; ‘কিন্তু–ধিক, বৃথা চিন্তা, তোরে!, “কি লজ্জা! কেমন তুই, রে পোড়া লেখনি,/ লিখিলি ও পাপ কথা……… ” ইত্যাদি বাক্যে রেখাচিহ্নিত শব্দগুলিতে মেয়েলি ভাষার নিজস্ব টোন ধরা পড়েছে। এ জাতীয় ভাষা ব্যবহার পত্রকাব্যগুলিতে নায়িকা চরিত্রের সঙ্গে অত্যন্ত মানানসই হয়ে উঠেছে।

এ পত্রে নায়িকা তারার মনে যে সংশয়, দ্বিধা রয়েছে তা অনস্বীকার্য। তিনি যা করতে চলেছেন সে যে বিষম অন্যায় তা তিনি জানতেন। কিন্তু তবুও নিজেকে ফেরাতে পারছেন না। এজন্য তিনি আত্মধিক্কার করেছেন—

“জন্ম মম মহা ঋষিকুলে,

তবু চণ্ডালিনী আমি?’

কিন্তু তারার এই আত্মসঙ্কট নাটকীয় দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে পত্রের শেষের দিকে গীতিকবিতার সুর উৎসারিত করেছে। শেষ পক্তিতে তিনি বলেছেন—

‘.…….কি আর কহিব ?

জীবন মরণ মম আজি তব হাতে!

—নাট্যচাতুর্য ও গীতিপ্রবণতার এ জাতীয় মিশ্রণ বীরাঙ্গনা-র প্রতিটি পত্রেই উপস্থিত ৷

অমিত্রাক্ষর ছন্দে পত্রটি রচিত। এই ছন্দ মূলত মহাকাব্য রচনার উপযোগী। তবে মধুসূদন ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে বস্তুনিষ্ট বিষয়ও উদাত্ত ভাব প্রকাশের পাশাপাশি এ ছন্দ লিরিকের সুকোমল মাধুর্য্যভার প্রকাশেও সমান উপযোগী। এই ছন্দে মানবের বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির বিচিত্র রহস্য, বিচিত্র রূপ উভয়ই ধরা পড়ে। ‘তারা’ পত্রিকাও অবশ্যই তার প্রমাণ।

এ পত্রিকার ভাষা সহজ, সরল। তারা আত্মসমীক্ষার সুরে তার মনের কথা প্রকাশ করেছে–

‘এ নব যৌবন, বিধু, অর্পিব গোপনে

তোমায় ; গোপনে যথা অর্পেণ আনিয়া

সিন্ধুপদে মন্দাকিনী, স্বর্ণ, হীরা, মণি!’

এখানে উপমার ব্যবহার অলংকারে পর্যবসিত না হয়েও তা নব যৌবনের বিভিন্ন ধর্মকে কে ব্যক্ত করেছে।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment