‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে ও ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য কবি মধুসূদনের বিজয় বৈজয়ন্তী। যদি মেঘনাদবধ কাব্যকে বলা যায় সুমহান, তবে বীরঙ্গনাকে বলতে হয় সুমধুর। প্রথমটির মধ্যে আছে ভাবকল্পনার বিরাটত্ব, দ্বিতীয়টির মধ্যে আছে রসব্যঞ্জনার অভিনবত্ব। একটি জাতির হৃদয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, অন্যটি ব্যক্তির মর্মরসে অভিষিক্ত। একটিতে গভীর গাম্ভীর্য, অন্যটিতে ললিত লাবণ্য। একটি হিমালয়, অন্যটি তাজমহল। একটি শ্রদ্ধেয়, অপরটি প্রিয়।

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে প্রাক্ বীরাঙ্গনা অঙ্গনাদের ভুললে চলবে না। নারীর সৌন্দর্যচেতনা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, নারীত্বের প্রতি সম্মান নবজাগৃতির আদর্শের উদ্‌বোধন ঘটিয়েছে। আত্মপ্রত্যয়ী শব্দসচেতন কবি মধুসূদন বীরাঙ্গনা নামকরণের মধ্যেই শ্রদ্ধা ও সৌন্দর্যের এক মিলিত রূপের পরিচয় রেখে গিয়েছেন। মধুসূদনের কাব্যের নামকরণের গভীরতা অনেক সমালোচক উপলব্ধি করতে না পেরে নিজেও বিভ্রান্ত হয়েছেন অপরকেও বিভ্রান্ত করেছেন। মধুসূদন সম্পর্কে কোনো স্পর্ধিত উক্তি প্রকাশ করবার পূর্বে একটু বিবেচনা করে দেখা দরকার। বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের তাৎপর্য অনুধাবনের পূর্বে সাধারণভাবে বীরাঙ্গনা সম্পর্কে মধুসূদনের বক্তব্য জানা দরকার।

…But within the last few weeks, I have been scribbling a thing to be called বীরাঙ্গনা i.e., Heroic epistles from the most moted puranic women to their lovers or lords. There are to be twenty one epistles, and I have finished eleven. Those are being printed off, for I have no time to finish the remainder…… The first series contain (1) Sacuntala to Dusmanta, (2) Tara to Some, (3) Rukmini to Dwarakanath, (4) Kaikayee to Dasarath, (5) Suparnakha to Lakshman, (6) Droupadi to Arjuna, (7) Bhanumati to Durjodhana, (8) Dushala to Jayadratha,(9) Jana to Niladhwaja, (10) Jahnavi to Santanu, (11) Urbashi to Purwrabas, a goodly list, my friend….But I suppose, my poetical carrer is drawing to a close. I am making arrangments to go to England to study for the Bar and must bid adiue to the Muse.”

এখন মধুসূদনের ভাষায় noted women বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা আমাদের অনুধাবন করা প্রয়োজন। একাদশ পত্রিকার মধ্যে দ্রৌপদী, ভানুমতী, দুঃশলা এবং জনা—এই চারজন ক্ষাত্ররমণী হলেও, একমাত্র জনা ব্যতীত ক্ষাত্ররমণীসুলভ তেজস্বিতা কারোর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। জনাকে বাদ দিলে ক্ষাত্ররমণী থাকে তিনজন—দ্রৌপদী দুঃশালা ও ভানুমতী। দ্রৌপদীর পত্রে স্বামীর বীর্যবত্তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেলেও তিনি নিজের প্রেমময়ী সত্তাটিকেই সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেছেন। বাকী দুইটি ক্ষাত্রনারী চরিত্র—দুঃশলা ও ভানুমতীর চরিত্রে বীর্যবত্তা তো নেই, বরং তার বিপরীত চিত্রই লক্ষ্য করা যায়। পত্রিকারম্ভে ভানুমতী লিখেছেন—

অধীর সতত দাসী, যে অবধি তুমি

কবি যাত্রা পশিয়াছ কুরুক্ষেত্র রণে 

নাহি নিদ্রা, নাহি রুচি, হে নাথ আহারে।

মধুসূদনের যদি ভানুমতীকে বীর্যবতী রমণী বলে অঙ্কন করার বাসনা থাকত তবে কখনই তিনি ভানুমতীর মুখে এইপ্রকার সংলাপ সংযুক্ত করতেন না। ক্ষত্রিয় নৃপতির কাছে যুদ্ধ-বিগ্রহ আকস্মিক ব্যাপার নয় তা চূড়ান্ত ভীতিপ্রদত্তও নয়। তেমন ক্ষত্রিয় নৃপতির স্ত্রী হয়ে যুদ্ধের নামে মুৰ্চ্ছা যাবেন এটি অকল্পিত। সুতরাং ক্ষত্রিয় রমণীর বীর্যপ্রকাশ করবার জন্য মধুসূদন লেখনী ধারণ করেনি।

দুঃশলাও স্বামীকে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে আসবার জন্য অনুনয় করে পত্র লিখেছিলেন—

এক তুমি, এস নাথ, রণপরিহরি।

ফেলি দূরে বর্ম, চর্ম, অসি, তৃণ, ধনুঃ 

ত্যজি রথ, পদব্রজে এস মোর পাশে 

কপোত মিথুন সব যাব উড়ি নীড়ে।

অধিক উদ্ধৃতির প্রয়োজন নেই। এই থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বীর নারী চরিত্র অঙ্কন করবার বাসনা মধুসূদনের লক্ষ্য ছিল না। সুতরাং ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি শোনামাত্র রাণী দুর্গাবতী, ঝান্সির রাণী লক্ষ্মীবাই-এর কথা যাদের মনে উদিত হয় এবং সেই আদর্শে বীরাঙ্গনা নাম চরিত্র ও নামকরণের সার্থকতা বিচার করতে বসেন, তারা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বীরাঙ্গনা শব্দটি বিশ্লেষণ করলে বীরা ও অঙ্গনা দুইটি শব্দ পাওয়া যায়। বীরা শব্দের অর্থ যে নারীর পতি ও পুত্র বর্তমান। ইহার বিপরীতেই অবীরা শব্দটি গঠিত হয়েছে। এখন বীরা শব্দ ধরে বীরাঙ্গনার অর্থ বিচার করতে করতে গেলে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হবে। বীরাঙ্গনার কোন কোন্ নায়িকার পতি ও পুত্র বর্তমান থাকলেও প্রত্যেক নায়িকা সম্পর্কে তা প্রযোজ্য নয়। তার ওপর নায়িকাদের মধ্যে কেউ বা কুমারী, কেউ বা বিধবা, কেউ বা বারবণিতা এবং কেউ বা বিবাহিতা হলেও অপুত্রক। সুতরাং এস্থলে বীরা শব্দটি গ্রহণীয় নয়।

কোনো একজন সমালোচক বলেছেন যে, এই কাব্যের নারীর সাহসের সঙ্গে নিজের অন্তর্জীবনের কথা অবলীলাক্রমে প্রকাশ করেছেন। বীরত্বের সঙ্গে আত্মঘোষণার জন্য এই নাম পরিকল্পিত হয়েছে। কাব্যের প্রত্যেক নায়িকার মনোধর্মের নিরিখে এই মন্তব্য অযথার্থ নয়। তবে বীরাঙ্গনা শব্দ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে চিন্তা করবার আছে।

বীর শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে বি + ইব পাওয়া যায়। এর এক অর্থ বিশিষ্ট প্রেরণা।

এই অর্থে বীরাঙ্গনার অর্থ ধরলে অর্থ হয় বিশিষ্ট প্রেরণাদাত্রী নারী। নারী তো পুরুষের মনে প্রেরণা জাগায়। বীরাঙ্গনা কাব্যের অর্জুনের প্রতি দৌপদী কবিতায় এরই স্পষ্ট পরিচয় আছে । দ্রৌপদীর স্বয়ম্ভর সভায় ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনকে সভাস্থ সকল নৃপতি যখন বেষ্টন করে যুদ্ধের প্রতি প্রস্তুত হচ্ছিল তখন অর্জুন দ্রৌপদীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন—

আশারূপে মোর পাশে দাঁড়াও রূপসি !

দ্বিগুণ বাড়িবে বল চন্দ্রমুখ হেরি

চন্দ্ৰমুখি।

এই অর্থ শুধু অভিধানেই লিপিবদ্ধ নয়, মধুসূদনের কাব্যেও এরও সমর্থন আছে এবং এই প্রকার অর্থ বিচার যুক্তিসহ ও যথার্থ। কিন্তু এই অর্থে মধুসূদনের চরিত্রগুলি Most noted Puranic women নয়। অর্থাৎ বীরের এই গ্রহণযোগ্য হলেও তা মধুসূদনের অভিলাষিত অর্থ নয়।

বীর শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় বীর—অ(অচ) ক। এর অর্থ শ্রেষ্ঠ বা উত্তম। তিন লিঙ্গে একই ব্যবহারর। হেমচন্দ্রও এই অর্থের নির্দেশ দিয়েছেন। এই অর্থ মূল বেদের মধ্যেই গৃহীত হয়েছে। আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে ঋগ্বেদেব শ্লোকটির অনুসরণ করা যেতে পারে—

ইহা হি বা বিধতে রত্নমস্তীদা 

বীরায় দাশুষ উষাসঃ। 

(ঋগ্বেদ-৬ : ৬৫ : ৪)

কেবল সংস্কৃতেই নয় বাঙলা ভাষাতেও বীর শব্দ শ্রেষ্ঠ অর্থে বহুস্থানে প্রযুক্ত হয়েছে। চিন্তাবীর, ধর্মবীর, কর্মবীর শব্দগুলি এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। চিন্তাবীর শব্দটিই ধরা যাক। এর অর্থ চিন্তার বীরত্ব দেখিয়েছিলেন এমন নিশ্চয়ই নয়। এর অর্থ শ্রেষ্ঠ চিত্তক। সুতরাং বাঙলাতেও বীর অর্থে শ্রেষ্ঠ প্রযুক্ত।

এখন বীরাঙ্গনা শব্দটিকে ভাঙলে বীর ও অঙ্গনা পাওয়া যায়। বীর শব্দটি এ স্থলে অঙ্গনার বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং বীরাঙ্গনা শব্দটির অর্থ এখানে শ্রেষ্ঠ নারী।

কিন্তু এতেই সবটুকু নয়। অঙ্গনা শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে আরও উল্লেখযোগ্য পরিচয় লাভ করতে পারব। কারণ অঙ্গনার অর্থ শুধুমাত্র নারী, ললনা, কামিনীর বা রমণী নয়। অঙ্গনা শব্দের বিভাজনে পাওয়া যায়-অঙ্গন (প্রশংসার্থে) + আ (স্ত্রীলিঙ্গে)— অঙ্গ সুন্দর যে নারীর। অতএব বীরাঙ্গনা শব্দটির অর্থ হল শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী। এই শ্রেষ্ঠত্ব বীর্যের বিচারে। সুতরাং বীরাঙ্গনা শব্দটির মধ্যেই বীর্য ও সৌন্দর্যের মিলিত পরিচয় নিহিত আছে।

মধুসূদন একেই বলেছেন Most noted Puranic women রেনেসাঁসের চেতনায় প্রত্যয়বান মধুসূদন সৌন্দর্য মাধুর্যের সঙ্গে বীর্যের সম্মিলন ঘটিয়েই নারীকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। নারীদেহকে স্থূল দেহ-প্রবৃত্তি চারিতার্থতার যন্ত্ররূপে দেখেননি, তার মধ্যে সৌন্দর্য-চেতনা জাগ্রত করেছেন। তিনি কেবল নারীর অশ্রুসজল বিষাদিনী মূর্তিই অঙ্কন করেননি প্রেমের বীর্যে অশংকিনী মূর্তিও উপস্থাপিত করেছেন। এরই পূর্ণতম অভিব্যক্তি বীরাঙ্গনা কাব্যে।

নবযুগের স্বাতন্ত্র্যময়ী নারীকে অঙ্গনা ছাড়া আর কোনো শব্দে বিশষিত করা যায় ? শব্দ সচেতন কবি মধুসূদন সঙ্গতভাবেই ওই নামকরণ গ্রহণ করেছেন। অন্য কোনো স্ত্রী বাচক শব্দের মধ্যে এমন সুরুচি, সঙ্গতি ও সৌন্দর্যের পরিচয় মেলে না। অঙ্গনার সমগোত্রীয় শব্দ—নারী, ললনা, কামিনী, রমণী ইত্যাদি শব্দগুলির তাৎপর্য অনুধাবন করলেই আমাদের উক্তির যথার্থতা প্রতিপন্ন হবে। নারী শব্দ নর নির্ভর–সুতরাং এই শব্দ নারীর স্বাতন্ত্র্য বিকাশের সহায়ক নয় । যে নারী কেবল পুরুষের মুখাপেক্ষী সে নারী মধুসূদনের মানস দুহিতা হবার যোগ্যতা রাখেনা। নারী শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় নর+অ() + ঈপ (ধর্মার্থে)—অর্থাৎ মনুষ্য জাতির যে অংশ সন্তান প্রসব করে। এমন শব্দ মধুসূদন নিশ্চয়ই গ্রহণ করেননি। নারীর অপর প্রতিশব্দ ললনা-লল্ / অট—অর্থাৎ কটাক্ষ, ভঙ্গী প্রদর্শনকারী রমণী। ছলকলায় এই ললনা অভিজ্ঞ। এই ললনার পরিচয় পেতে হলে ভারতচন্দ্রই যথেষ্ট, তার জন্য মধুসূদনের প্রয়োজন নেই।

নারীর প্রতিশব্দ কামিনী ধরলে অর্থ হয় কামিনী নারী। কাম + ইন (অস্প্যর্থে) + ই (স্ত্রীলিঙ্গ)। মধুসূদনের নারী চরিত্রে কামের পারবশ্য নেই, আছে প্রেমের বীর্য। কামের ঊর্ধ্বে প্রেমকে মধুসূদনই সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা নেই। তাঁর জীবনে ও কাব্যে এই পরিচয় ছড়িয়ে আছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই মধুসূদন কামিনী শব্দ গ্রহণ করেননি। রমণী শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়—রম্ + নিচ + অন (ম) + ঈ (স্ত্রী) এর শব্দার্থ হল রমনকারিণী অর্থাৎ রতিক্রিয়াকারিনী নারী। শব্দটির মধ্যে মধুসূদন অবশ্যই সুরুচি ও শিষ্টতা খুঁজে পাননি। সতী, সাধ্বী শব্দগুলি বহু ব্যবহার মলিন এবং তাদের ব্যবহার এক পক্ষের। অভ্রান্ত কবি সংস্কারের ফলেই মধুসূধন অঙ্গনা শব্দটিকে বেছে নিয়েছেন। সৌন্দর্য প্রেম ও বীর্যে বীরাঙ্গনার প্রতিটি চরিত্রই অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছে। সুতরাং কাব্যটির বীরাঙ্গনা নাম সার্থক হয়ে উঠেছে।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment