পৌরাণিক নারী চরিত্রগুলির মধ্যে কবি মধুসূদন এনেছেন আধুনিক কালানুযায়ী বিশিষ্ট মানসিকতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লক্ষণীয় বিষয় এই যে তিনি প্রাচীন প্রেক্ষাপটকে কখনও অস্বীকার করেননি। বীর্য ও সৌন্দর্যের মিলিত পরিচয়ে অদম হয়ে উঠেছে প্রতিটি নারীচরিত্রই। শুধু দেহহীন প্রেমের লাবণ্য বিলাস নয়, কিংবা দেহসর্বস্ব কামনার কালিদহে নিমজ্জমান নয় মধুসূদন দেখিয়েছেন প্রেমের জন্য নারীর কখনও মধুর, বিরহকাতুতরা রূপ কখনও বা প্রতিবাদীনীরূপ। মধুসূদন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে প্রেমিকা নারীদের বীরাঙ্গনা করে তুলেছেন তাদের আত্মমর্যাদাবোধ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এবং অন্তরের অন্তরের আশঙ্কার প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে।
মধুসূদন ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নারী চরিত্রগুলি ভারতীয় মহাকাব্য নাটকও পুরাণ থেকে নিলেও ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে বেজে উঠেছে আধুনিকতার নতুন রাগিনী। এ কাব্যের নারীগুলি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যেবোধে উজ্জ্বলময়ী। ঊনবিংশ শতকের বাংলাদেশের নব জাগরণের যজ্ঞকুণ্ড থেকে তাঁদের নববেশে আবির্ভাব। একাব্য রচনাকালে পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে কবির মনোজীবন গড়ে উঠেছিল। পৌরাণিক নারী চরিত্রগুলি নব্য বাংলার ধ্যান ধারণা, ভাবনা চিন্তা ও মানবতাবোধে নতুন আদর্শে পুনরুজ্জীবিত হয়ে দেখা দিয়েছে। নারী জাগরণের আধুনিক পটভূমিতে পৌরাণিক নারীদের অধিকারবোধে জাগ্রত করার প্রয়াসী হয়ে মধুসূদন তাদের বীরঙ্গনা রূপে অঙ্কন করেছেন।
পাশ্চাত্ত্য কাব্যোদানের নানাভাব আহরণ করে মধুসূদন যে নতুন কাব্য রচনা করেছেন তারাই অভিনব সৌরভে প্রাচীন নারীর নতুন ভাব ও ভাবনায় আধুনিকতার রসমূর্তিতে পরিণত হয়েছে। তারা আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার আলোকে উদ্ভাসিত। পুরুষ শাষিত সমাজে নারীদের মধুসূদন উজ্জ্বল তারকার ন্যায় সৃষ্টি করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শেষ পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে রচনার প্রেরণাস্থল প্রসিদ্ধ রোমান কবি ওভিদের পত্রকাব্য ‘Heroides’ এখানে একুশটি কবিতায় ১৮ জন নারী তাদের প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে প্রণয় বাসনা ব্যক্ত করেছে। চিত্তবৃত্তিতে খরদীপ্তময়ী নায়িকাদের কেউ রোমান্টিক প্রেমের শিখরে, কেউ দুর্বল চিত্ত স্বামীর বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ, কেউ পরকীয়া প্রেমে চঞল, কেউ পতি বিরহে জর্জরিত, কেউ স্বামীর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের তিরস্কারে ব্যঙ্গে দীপ্তিময়ী। পুরুষ শাসিত সমাজে নিজস্ব মনোভাবের বলিষ্ট প্রকাশেই এই বীরাঙ্গনারা আধুনিক।
মধুসূদন প্রাচীন নারীদের মুখে আধুনিক জীবনের ভাষা দান করে তাদের বাঙময় করে তুলেছেন। ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের মধ্যে পাশ্চাত্য প্রভাব অল্প বিস্তার থাকলেও ভারতীয় উপাদান ও নবজাগরণ জাত নতুন জীবনাদর্শকে এমনভাবে গ্রহণ করেছেন যে তাতে সিদ্ধরসের ব্যতায় ঘটেনি। এখানেই কবির স্বাধীন মন, কল্পনার স্বাতন্ত্র্য ও অপূর্ব বস্তু নির্মাণ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।
যুগধর্মের প্রভাবে মধুসূদন নতুন চেতনার আলোয় কাব্যটিকে রসাশ্রিত করে তুলেছেন। ‘তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যে’ ‘A new interpretation into old fact’-এ কাব্যে কবি নারীর রূপ সৌন্দর্য, নারীর দুর্বার হৃদয় বেদনা, দুর্ত্তেয় নারী রহস্য আমাদের সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবনবাদ এবং বাঙালি নারীচরিত্রের স্বপ্ন রূপই মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের মৌল প্রেরণা। এ সময় বাংলায় নবজাগরণের বড়ো অবদান সমাজ জীবনে নারীকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দান করা। বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্তরতম বৈশিষ্ট্যই এটাই।
বীরাঙ্গনার প্রত্যেকটি নায়িকার মনোভাব স্পষ্টভাবেই উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং যেভাবে তাদের মনের প্রতিটি দল ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়েছে তাতে নাটকীয়তা দেখা না দিয়ে পারেনি। পত্রগুলি কখনও কৌতূহল, কখনও বিস্ময়, কখনও অনিশ্চয়তা, কখনও দ্বন্দ্ব, কখনও উত্তেজনা আবার কখনও চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় পত্রিকাগুলির মধ্যে নাটকীয় উপাদান আছে। তবে তার মধ্যে সোমের প্রতি তারা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, নীলধ্বজের প্রতি জনা দশরথের প্রতি কেকয়ীতে নাটকীয় উপাদান এবং আধুনিকতা সবচেয়ে বেশি রসস্ফূর্তি লাভ করেছে।
‘বীরাঙ্গনার প্রথম কবিতা’ ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’। আত্মমর্যাদাশীল নারী শকুন্তলার স্বামীর ঐশ্বর্যের প্রতি লোভ নেই, তিনি কেবল স্বামীর সাহচর্য কামনা করেছেন যেটি নারীর চিরায়ত অধিকার। শকুন্তলার কণ্ঠে ঊনবিংশ শতাব্দীর একটা বিরাট প্রশ্ন—কার অপরাধে নারীকে বিপর্যস্ত বিড়ম্বিত জীবন যাপন করতে হয়। এ কবিতায় শকুন্তলা বহিরঙ্গে কুণ্ঠিতা হলেও তার সংযম সম্ভ্রম ও বিদ্রোহিনী ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে তার রচনায়।
মধুসূদন পৌরাণিক তারা চরিত্রকে প্রণয়ভিক্ষু রোমান্টিক নায়িকা হিসাবে চিত্রিত করেছেন ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রটিতে পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের সঙ্গে সংস্পর্শের সূত্রেই মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক প্রেমের সূচনা ঘটিয়েছেন। বহিরঙ্গের দিক থেকে সোমের প্রতি তারা অবৈধ প্রেমের অন্তর্দ্বন্দ্বপূর্ণ প্রণয়াকূল প্রার্থনা। সামাজিক রুচি অরুচি পাপ পূণ্য ন্যায় অন্যায়ের উর্দ্ধে তারার মনোবেদনা ও প্রেমাকুলতার মনস্তত্ত্ব সম্মত জীবনালেখ্য অঙ্কিত হয়েছে এ পত্রে। আর এখানেই কবির আধুনিকতা। সোমের সান্নিধ্য কামনায় তারা সম্পূর্ণ আত্ম সমর্পণ করতে চায় তাঁর কাছে।
দেহ পদাশ্রয় আসি, প্রেম উদাসিনী
আমি। যথা যাও যাব, করিব যা কর,
বিকাইব কায়মনঃ তব রাঙা পায়ে।
আধুনিক মন মধুসূদন সমাজ নিষিদ্ধ বুভুক্ষিত নারীর অপ্রতিরোধ্য প্রবৃত্তির উন্মাদনাকে রসঘন শিল্প সৌন্দর্য দান করেছেন এখানে।
‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’, পত্রে মধুসূদন রামায়ণের কৈকেয়ীকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধে উদ্দিপ্ত করে তুলেছেন। এপত্রে কেবল অভিমানিনী নায়িকার অনুযোগ নয় প্রকৃতি বীরাঙ্গনা সুলভ দৃপ্ত তেজ ও দুঃসাহসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। মোহগ্রস্তের মোহভঙ্গ ও অন্যায় অর্ধমের জন্য কেকয়ী যেভাবে দশরথের আঘাত হেনেছেন, তা প্রগতিশীল নারীর আপন অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন দৃষ্টিভঙ্গিকে দ্যোতিত করে তোলে।
‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রে জনা চরিত্রে মধুসূদন বীর রৌদ্র ও করুণ রসের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। স্বামীর ব্যবহারে পীড়িত নারীর মর্মজ্বালা ও আত্মমর্যাদা এই পত্রিকার মূল সুর। তিনি স্বামীর ভীরুতার প্রতি তীব্র প্রতিবাদে ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মমর্যাদার যুক্তিবাদী বিশ্লেষণধর্মী প্রবণতা দেখা যায় জনা চরিত্রে। তিনি প্রাচীন সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আঘাত হেনেছেন তথাকথিত মহত্ত্বের সন্ধান করেছেন তিনি। স্বামীকে ক্ষত্রিয় ধর্মে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ জনা ক্ষোভে ও লজ্জায় আহত সর্পিনীর মতো গর্জন করে উঠেছেন।
‘অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী’ পত্রিকাতে নায়িকা দ্রৌপদীর প্রোষিতভর্তৃকার চিত্র সুন্দর ফুটে উঠেছে। বিরহের বেদনা তাকে বিবশ করলেও ‘স্বামীর বিবাহ কুন্তলের’ প্রতি তাঁর ব্যঙ্গোক্তি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যময়ী ধ্রুপদ কন্যার উপযোগী হয়েছে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে নারীর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সতীত্ব। প্রতিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করা, পতির আদেশ মেনে চলাই ছিল তাদের জীবনধর্ম। পুরুষ নিরপেক্ষ তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মধুসূদন নারীকে আধুনিক বেশে আধুনিক রূপে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন একাব্যে। মহাকাব্যের অভিজাত্যের অন্তরাল থেকে বের হয়ে আসা নারী চরিত্রগুলি আপন আপন নারী সুলভ বৈশিষ্ট্যে, নারী প্রকৃতির বিচিত্র আবেগে, আত্ম পরিচয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিচিত্ররুপিণী নারীর অন্তঃপ্রকৃতি এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখানেই বীরাঙ্গনা’র আধুনিক জীবন চেতনার প্রতিষ্ঠা। মধুসূধনের ‘বীরাঙ্গনা’ নবযুগের বাঙালি নারী চেতনার প্রথম শিল্পাভিব্যক্তি।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর