‘মাতৃত্বের কোমলতার দিক থেকে অভিন্ন হলেও জনা ও কেকয়ী ভিন্ন ভিন্ন অর্থে বীরাসেনা’ –আলোচনা করো।

কেকয়ী ও জনার পত্রিকা অনেকাংশেই সমশ্রেণিভুক্ত। উভয়েই প্রথমত ও প্রধানত অনুযোগ পত্রিকা এবং উভয়েই মাতৃত্বের কোমলতার দিক থেকে অভিন্ন কারণ উভয়েই তাদের পুত্রের ওপর অবিচারের প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাদের স্বামীর কাছে। তবুও তাদের পার্থক্য রেখা নিতান্তই সূক্ষ্ম নয়। যে মৌলিক ব্যবধান আলোচ্য পত্রিকাদুটিতে সমশ্রেণির হওয়া সত্ত্বেও একেবারে পৃথক করেছে, তার ভিত্তি লুক্কায়িত আছে প্রকৃতির মধ্যে। যে তেজ, যে বীভর, যে উষ্মা ও অভিমান এই দুই অনুযোগ পত্রিকাকে সমশ্রেণির করেছে। কেকয়ীর ক্ষেত্রে তার উৎস হল নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থ ও জনার ক্ষেত্রে এক সুমহান আদর্শবোধ। রাজার দুর্বল মুহূর্তের এক মুখের কথার দোহাই দিয়ে সপত্নী পুত্র জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের স্থলে আপন পুত্র ভরতের জন্য সিংহাসনের দাবি জানানো, আর ক্ষত্রিয় হয়েও অবমাননার জন্য ধিক্কার জানানো—এই জয়ের মধ্যে কতই না পার্থক্য ! স্বামীকে ‘রাজঋষি’ সম্বোধন করে ‘পাইলা কি পুন এ বয়সে—রসময়ী নারী ধাম’–এই জিজ্ঞাসার মধ্যে যে দেবীর যে রীতি, অথবা নিজের বিলীয়মান যৌবন সম্পদ ও সৌন্দর্যের মধ্যে আক্ষেপ, পুত্রের প্রতিষ্ঠা ও যৌবরাজ্য দাবিকে ছাড়িয়ে গিয়ে তাঁর অসংকোচে যে বক্তব্য—’না পড়ি চলিয়া আর নিতম্বের ভারে! তা অমার্জিত ও কদর্য। এমন কে কলুষ স্পর্শ জনার চরিত্রটিতে মেলে না। জনার পত্রে ব্যঙ্গের অভাব নেই কিন্তু তা এতই সংযত পরিশীলিত তাকে ব্যঙ্গ বলে চেনাই যায় না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পত্রের শেষে উভয় পরিধান গৃহ ত্যাগের সংকল্প জানিয়েছেন— কিন্তু এই মনোভাবের মধ্যেও তা পাতাল অর্থাৎ দুই নারীর। জনার যাইবার সময়েও স্বামীর জন্য অন্তর কাঁদছে। কঠিনে ও কোমলে মিশ্রিত হয়ে জনার চরিত্র এক অদ্ভুত Sublimity লাভ করেছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে কেকয়ী যখন বলেন ‘যাই চলি আমি’—কিন্তু তাতে নেই অভিমান আছে শুধু অসূয়া ও বিদ্বেষ। উল্লেখ হল তার মুখে ‘পরম অধৰ্ম্মচারী রঘু-কুল পতি’—এই উক্তির পুনঃপুনঃ আবৃত্তি। স্বামীর অন্যায়ের জন্য স্বামীকে আঘাত কেকয়ী করেছেন কিন্তু সে আঘাত কখনই তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে বেড়াজাল ভেঙে দেয়নি, এই আঘাতে অন্তরে আঘাত দাত্রী জনাও কাতরা হয়েছে, কিন্তু কেকয়ী যখন ‘পরম অধর্ম্মচারী রঘু-কুল-পতি’ বলেন তখন রঘু-কুল-পতির সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কটি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, ও এক উৎকট উল্লাস নায়িকাকে পেয়ে বসে। অর্থাৎ কেকয়ীর পত্রিকা যেন রাজঅন্তঃপুরী কলজ-স্বার্থস্বপ্ন পুরোপুরি দাঁত নখ বের করে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। এর তুলনায় স্বামীর প্রতি জনার ভর্ৎসনা ভাষণ অনেক বেশি সোচ্চার ও গৌরবদীপ্ত। প্রকৃত বীরঙ্গনা শোভন তেজস্বীতায় জনা নীলধ্বজকে উৎসাহিত করেছেন শত্রুর বিরুদ্ধে রণসম্মান—

‘টুট কিরীটির গর্ব্ব আজি রণস্থলে

খণ্ড মুণ্ড তার আন শূল দণ্ড শায়?

এই শৌর্যজ্জ্বল ছবির গরিমাই অন্য, এই গরিমাই জনাকে বীরাঙ্গনার স্বাদ দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে কেকয়ীর পত্রর উপসংহার মাত্র একবারই ক্ষত্রিই নারীশোভন, প্রকৃত বীরাঙ্গনার মতো দীপ্ত উক্তি পাই—

‘চিরি বক্ষ মনোদুঃখে লিখিনু শেণিতে লেখা’

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment