কাব্য সাহিত্য সব দেশে এবং সবকালেই নানা রকম আঙ্গিকে লেখা হয়ে থাকে সুতরাং আঙ্গিক হিসাবে চিঠির মাধ্যমে লিখিত হবে তাতে আর বিচিত্র কী? চিঠির আঙ্গিকে কবিতা লেখাতে তাই কবিরা এক সময় এগিয়ে এলেন। উৎসাহ দেখা গেল এ রীতিতে কাব্য লেখার। আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যে ‘দূত’ কাব্য আছে। এই ধরনের কাব্যে কবি নায়িকাদের জবানীতে বিস্তর কথা বলেছেন। যে নারীর জবানীতে বলা হয়েছে, তার মনের কথা এই সকল কাব্যে রীতিমত প্রতিফলিত, কিন্তু এগুলি নিছক বর্ণনামূলক কাব্য, এগুলি ঠিক চিঠি বা লিপি নয়– কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্য পাঠ করলে দেখা যায়—মেঘকে দূত হিসাবে সম্বোধন করে বিরহী যক্ষ প্রায় একশো কবিতা বলে গেছেন। এগুলিকে সংলাপ বলে মেনে নিলেও এদের কোনো রকমে চিঠি বলা যায় না। চিঠির ভিতরে সে সহজ আন্তরিকতা আপন মনের কথা এবং সর্বোপরি পত্রলেখক ও পত্র প্রাপকের ভেতরের ছোটো একটি সীমায়িত জগৎ থাকে, তা মেঘদূত কাব্যের কোথাও নেই। বরং যা আছে তার ঠিক বিপরীত। সমলোচকের ভাষায়—‘এ যেন মেঘের হাত ধরে বিশ্ব পরিক্রমা।
সংস্কৃত সাহিত্যের পরিসর বিশাল, শতকের পর শতক ধরে অজস্র কবির হাতে সৃষ্ট হয়েছে এই সাহিত্য। লিখিত হয়েছে নানা ধরনের কবিতা, নায়ক-নায়িকাদের জবানীতে কবিরা অনেক কথাই লিখেছেন, কিন্তু ‘পত্রকাব্য’ বলতে যা বোঝায়, সেই রীতির কাব্য সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা দেখতে পাই না। সুতরাং এ কাব্য রচনায় মধুসূদন যে বিশেষ কোনো সংস্কৃত কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, একথা কোনো রকমেই বলা যায় না। তিনি প্রত্যক্ষভাবে ওডিদের Epistula গুলিকে অনুসরণ করেছেন। অন্য কোনো পত্রকাব্যকে নয়, পত্রকাব্যের বিচারে যে যে দিকগুলি নাচিয়ে দেখতে হয়, তার ভেতরে উল্লেখ্য হল পত্রলেখার ও পত্র প্রাপকের পারস্পরিক সম্পর্কের স্বচ্ছতা। পত্রের ভেতর যেন অপ্রাসঙ্গিক বিষয় এবং অকারণ বাগাড়ম্বরা না থাকে, তাও দেখা দরকার। পত্রলেখক বা পত্রলেখিকার মনের গোপন কথা যেসব সঠিকভাবে প্রকাশ পায় এবং ওই চিঠির ভেতর দিয়ে তা যেন ব্যক্তিমনের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। মোটকথা চিঠির রস হল, আন্তরিকতা সহজ রস। ওই সহজ রস যেন অকারণ পণ্ডিত্যের ভারে খর্ব না হয়।
এই সকল বিষয় মাথায় রেখে মধুসূদনের বীরাঙ্গনাকে (Epistoloary verse) পত্রকাব্য বলা যায়। প্রোষিতভর্তৃকা শকুন্তলা তার লিখিত পত্রিকায় এমন অনেক কথা লিখেছেন, যা একান্ত ভাবে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার। অন্য কারো নয়, একান্তভাবে এগুলি তাদের নিজস্ব। এমন অনেক অনুভবের কথা এরা বলেছেন, যা স্বামী ছাড়া আর কাউকে বলা যায় না। চিঠিতে যেভাবে পত্রলেখিকারা নিজের নিজের মনকে মেলে ধরে, ঠিক সেইভাবেই নিজের মনকে মেলে ধরেছেন শকুন্তলা। কোথাও রয়েছে বিরহের আবেগ, কোথাও রয়েছে কিছু কিছু অভিমান সহ তর্ক বিচার। আবার কোথাও রয়েছে দুঃখ ও অভিযোগের কথা। ‘সোমের প্রতি তারা’ হল এক অনৈতিক প্রেমপত্র। গুরুপত্নী এটি লিখেছেন তার স্বামীর এক পড়ুয়া ছাত্রের কাছে। সংস্কারের সঙ্গে লড়াই। আর রয়েছে ভালোবাসার চোরাস্রোত, যা গোটা চিঠিটাকে আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। ‘দ্বারকানাথের প্রতি রুক্মিনী’-ও একটি সার্থক প্রেমপত্র তবে প্রকার ও প্রকরণে এটি কোনো ক্রমেই তারার চিঠির মতো উত্তেজক ও মানবিক নয়, এখানে রয়েছে কুমারী মেয়ের আর একজন ছিনিয়ে না নিয়ে যেতে পারে, তারজন্য রয়েছে ব্যাকুলতা। ওই বিপন্ন প্রেমিকাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্য প্রেমিকের কাছে রয়েছে প্রেমিকার আর্তি, চিঠিতে সহজ সরল আন্তরিকার সঙ্গে এসে মিশেছে নায়িকার পূর্ব রাগের সোনালি প্রেমের স্বপ্ন।
অনুরূপ, লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দশরথের প্রতি কৈকেয়ী, নীলধ্বজের প্রতি জনা উর্বশী, জাহ্নবী ভানুমতি, দুঃশলা প্রভৃতি বীরঙ্গনা কাব্যের এই পত্রিকাগুলিকে একের পর এক বিশ্লেষণ করল দেখা যায়, এগুলি ভেতর পত্রকাব্যের লক্ষণ খুবই প্রবল, সামান্য কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এ বিচ্যুতি সরের উপেক্ষণীয়। তবে একথাও মনে রাখা দরকার, নিছক পত্রকাব্য হিসাবে বিচার করলে বীরাঙ্গনার ওপর অবিচার করা হবে। কারণ এগুলি পত্র হিসাবে লিখিত হলেও এর মধ্যে গীতি লক্ষণ (Ly Microm) বাড়তি এক মাত্রা দিয়েছে, হৃদয়ের গভীরে বীরাঙ্গনার এই নায়িকার যে ভালোবাসা অনুভব করেছে, তা একই সঙ্গে রোমান্টিক ও রহস্যময়, এই প্রেমই হল তাদের প্রধান উপজীব্য, আবার জীয়ন কাঠিও। এরা প্রত্যেকেই তাই নিজের নিজের জগতে একান্তভাবে নিজের মতন। প্রত্যেকেই বলেছেন নিজের সমস্যার কথা, প্রত্যেকের চোখে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, প্রত্যেকেই পেতে চাইছেন নিজের নিজের মতো এক পৃথক সুন্দর এক অপরিচয়ের অজানা রহস্যময়তা, যা নায়িকাদের হৃদয়ের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এবং যা রয়েছে প্রকৃতি চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে। সব মিলিয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যে লিরিকের সব লক্ষণ তাই আশ্চর্যভাবে প্রকট।
এই গীতিকাব্যকে লক্ষণ ছাড়াও কাব্যটির ভেতর বাড়তি আরও একটি মাত্রা আছে, সেটি হল নাটকীয় সম্বোধন। বীরাঙ্গনাকে পত্রকাব্য বা গীতিকাব্য যাই বলা হকনা কেন, ভুললে চলবে না, এ কাব্যেটি নারীর মর্মকথার স্বগতোক্তি দিয়ে এই কাব্যে রচিত। ড. সুকুমার সেন এ সম্পর্কে বলেছেন : “বীরাঙ্গনার ভাব যেমন আবেগময়, ভাষা তেমনি সরল এবং ছন্দ নিরভাষি। সর্বোপরি আছে নাটকীয়তা। আসলে বীরাঙ্গনার অধিকাংশ কবিতাকে ভাসিক্য কাব্য (Dramatic Monologue) নাম দিলে ভুল হয় না।” সংস্কৃত সাহিত্যে এক ধরনের নাটককে বলা হয় ‘ভাস’, যার আক্ষরিক অর্থ হল স্বগতোক্তি। এই স্বগতোক্তি গ্রহণের ফলে এ ব্যাপারে নায়িকাদের মুখে ঝাঁঝাল বক্তব্য ও সুতীব্র ব্যঙ্গোক্তি শোনা যায়। প্রতিপক্ষের পুরুষটি নায়িকার বক্তব্যে মুহূর্তে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠেন Epistle পাঠকদের সামনে। ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ এবং ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ এই ধরনের পত্রিকার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, এখানে কেকয়ী ও জনার মানসিক যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে কোনো অসুবিধা হয় না পাঠকদের, সহজেই চরিত্র, যথা সত্যভ্রষ্ট মিথ্যাচারী দশরথ এবং কাপুরুষ নিবীর্য নীলধ্বজের চরিত্র দুটিকে যেন ‘আমরা’ চোখের সামনে দেখতে নাই। ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকায় তারার প্রেমতৃস্থা তারাকে যতখানি জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছে, ঠিক ততখানি জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছে সোমের চরিত্রও। বলা বাহুল্য, এ সবই সম্ভব হয়েছে স্বগতোক্তির প্রয়োগ কৌশলে। এই মনোলগ দ্বিমাত্রিক, এক মাত্রায় প্রকাশ নায়িকার মন, অন্য মাত্রায় নায়কের হাবভাব স্বভাব।
এইভাবে সঠিক মাত্রায় ‘বীরাঙ্গনা’ পত্রিকাগুলিকে যদি বিচার করা যায়, তাহলে একটি সংখ্যা সহজেই ঘনীভূত হতে পারে, মধুসূদনের এই পত্রিকাগুলি ঠিক কোন্ শ্রেণির ? এগুলি কী পত্র কাব্য ? গীতি কাব্য ? না Dramiatic Manologue ? মধুসুদনের এই পত্রিকাগুলিতে একই সঙ্গে মিশে রয়েছে গীতিকাব্য মন্ময়তা এবং নাটকের তন্ময়তা। সুতরাং ধন্দ বা সংশয় দেখা দিতে পারে এই কাব্যটির শ্রেণিবিচারের ক্ষেত্রে তবে ওডিদের কাব্যটিকে যেমন আমরা পত্রকাব্য বা Epistle গ্রহণ করেছি। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা আমরা তেমন হিসাবে গ্রহণ করলেও বলা যায় এর মধ্যে নাটকীয়তা ও গীতিকাব্যিক লক্ষণ আশ্বাস ভাবে সুসম্মানিত হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সৃষ্টি এবং মধুসূদনের আগে কিংবা পরে এ ধরনের রচিত হয়নি।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর