কবির ব্যক্তিগত জীবনবোধ, উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার জারণে যেমন কবিতা রচিত হয়ে থাকে, তেমনি আরও একটি কাব্য রচনার ধারা লক্ষ্য করা যায়। সে ধারা মুগ্ধ বর্ণনাত্মক। কবির নিজস্ব জীবনবোধ ছাড়াও যে সব সত্যে কিম্বা মতে বা ধারণায় কবি বিশ্বাসী তারই প্রচার মানসে কিম্বা মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে রচিত হয় আর এক ধরনের কাব্য কবিতা। প্রথমোক্ত কাব্য ধারাকে যদি বলি ব্যক্তিগত কবিতাবলী অপর ধারাকে তবে বলতে হয় বিষয়গত কাব্য। তবে অবশ্যস্বীকার্য, ব্যক্তিগত কাব্য বা কবিতাও কবির অন্তরের সত্যতার জারণে বিশ্ববোধে উন্নীত হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত কবির জীবনবোধের সত্যতার জারণে কবিতা এই বিশ্ববোধ বা সার্বজনীনতার গুণপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। কবি নতুন কিছু আপন সৃজনী শক্তিদ্বারা উদ্ভাবনই করুন বা অপর কোন মতের, আখ্যায়নের ব্যাখ্যাই করুন মূল কথা তাঁর অন্তরের জারণে তার নবায়ণ ঘটানো। এই যে দুধরনের রচনা ধারা—এরই একটিকে বলা যায় Lyric অন্যটিকে Ode।
Lyric অর্থে গীতি কবিতা। যে কবিতার মধ্যে কবির উপলব্ধি অভিজ্ঞতা নানা প্রকারে গীতিরস মাধুর্য সহকারে পরিবেশিত হয়েছে। যে কাব্য ও কবিতার মধ্যে সুরের উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায় তাই Lyric বা গীতিকবিতা। আর Ode বলতে বোঝানো হয় স্তুতি-কবিতাগুলিকে। Ode-এর সংজ্ঞা নিরূপণ করে বিভিন্ন পাশ্চাত্য সাহিত্য সমালোচক মন্তব্য করেছেন— “A rimed (rarely unrimed) lyric, often in the from of an address; generally dignified or exalted in subject, feeling and style”
অথবা, “Any strain of enthusiastic or exalted lyrical verse, directed to fixed purpose and dealing progressively with a dignified theme.”
বস্তুত স্তুতিবাচক বা স্তুতিমূলক কবিতা মাত্রই Ode। Ode-এর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতা—
হে বঙ্গ ভাঙারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি
পরধনে লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পর দেশে ভিক্ষা বৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কিম্বা, সর্বজন পরিচিত, সাহিত্য সম্রাটের, দেশ বন্দনা—
বন্দে মাতরম্
সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং
শস্য শ্যামলাং মাতরম্
—গানের কথাও উল্লেখ করা যায়। এ গানও Ode। ওড়-এর মধ্যে লিরিকধর্মীতা থাকতেও পারে। যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান—
“পতিতোদ্ধারীণি গঙ্গে
শ্যাম-বিটপি ঘন তট বিপ্লাবিনী
ধূষর তরঙ্গ ভঙ্গে”
গীতিময়তা থাকলেই যে তা Lyric হবে এমন নয়। গীতিকবিতার ধরনেও ওড় বা স্তুতিমূলক কবিতা রচিত হয়ে থাকে।
মাইকেল মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য ঐতিহ্য আশ্রয়ী হলেও ওড নয়। কেননা এখানে কারো স্তব স্তুতি প্রাধান্য লাভ করে নি। এখানে নায়িকাদের চিত্তবৃত্তি ভেদে হৃদয়-উচ্ছৃত আবেগ, সামাজিক পরিবেশ এবং তাঁদের সাধ্য সাধনের সংঘাতে এক গীতরসোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছে। নাটকীয় সংঘাতের ফলে গীতিধারা নিঃসৃত হয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যকে Lyric করে তুলেছে।
কাব্যে কবিতায় গল্পে নাটকে এবং সমস্ত সৃজনশীলতার মধ্যেই গীতোচ্ছ্বাস জাত হয় আবেগ থেকে কিম্বা বলা যেতে পারে আবেগের দ্বন্দ্ব থেকে। অপূর্ণ মানুষ যখন কল্পনায় পূর্ণতার সন্ধান করে তখনই তার মধ্যে আসে লিরিক-প্রেরণা। বীরাঙ্গনা তারার পত্রে যেমন করে ফুটে উঠেছে লিরিকধর্মীতা—
কুলের পিঞ্জর ভাঙ্গি-কুল-বিহঙ্গিনী
উড়িল পবন-পথে, ধর আসি তারে
তারানাথ।
কিম্বা—
এস তবে প্রাণসখে। তারানাথ তুমি
জুড়াও তারার জ্বালা ! নিজ রাজ্য ত্যজি
ভ্রমে কি বিদেশে রাজা, রাজকাজ ভুলি?
সদর্পে কন্দর্প নামে মীনধ্বজ রথী
পঞ্চ খর শর তূণে, পুষ্প ধনুঃ হাতে
আক্রমিছে পরাক্রমি অসহায় পুরী
কে তারে রক্ষিবে, সথে, তুমি না রক্ষিলে?
বীরঙ্গীনা কাব্যের মধ্যে কোথাও কোথাও ওডধর্মীতা লক্ষ্য করা যায়। কাব্যের প্রয়োজনে, নাটকীয়তা বজায় রাখতে কিম্বা নায়িকার পরিহাস কিম্বা নায়কের মধ্যে উদ্দীপ্ত রস সঞ্চারের জন্যে কোন কোন পত্রিকার মধ্যে ওড় জাতীয় স্তুতিবাচক অংশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন দ্রৌপদী পত্রিকায়, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর প্রেমের ও আস্থার পরিচয় দিতে কিছু অংশে স্তুতি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়—
পাণ্ডব-কুল-ভরসা, মহেষ্বাস, তুমি।
বিমুখিবে তুমি, সথে, সম্মুখ সমরে
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ শুরে; নাশিবে কৌরবে।
কিম্বা—
কে শিখায় অস্ত্র তোমা, বহ, সুরপুরে,
অস্ত্রী-কুল, গুরু তুমি? এই সুর-দলে
প্রচণ্ড গাণ্ডীবে তুমি টঙ্কারি হুঙ্কারে
দমিলা খাণ্ডব রণে? জিনিলা একাঙ্কী
লক্ষ রাজে, রথীরাজ লক্ষ্য ভেদ কালে
নিপাতিলা ভূমিতলে বলে ছদ্মবেশী
কিরাতেরে।
গীতিকবিতা বা Lyric-এর অপর একটি লক্ষণ হল, এ কবিতায় কোন গল্প, আখ্যান কিম্বা কবিতার মধ্যে সংলাপ মুখরতা থাকতে পারে। সেদিক থেকে বিচার করতে বসলে দেখা যায় বীরাঙ্গনা কাব্য পৌরাণিক কাহিনীর উপাদান নিয়ে গঠিত। যদিও কবি মধুসুদন তাঁর কাব্যের প্রয়োজনে কখনও কখনও পৌরাণিক উপাদানগুলির কিছু কিছু পরিবর্তন সাধন করে নিয়েছেন তবু তার মধ্যে একটা আখ্যান বস্তু থেকে গেছে। আরও লক্ষ্য করা যায় এ কাব্যের সংলাপ মুখরতা। পত্রাকারে লিখিত কাব্যগুলির মধ্যে নায়িকা বা পত্রিকা প্রেরিকার মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। যার ফলে বীরাঙ্গনা কাব্য Dramatic Monologue বা একোক্তিমূলক কবিতায় পরিণত হয়েছে। এই একোক্তিমূলকতাই কাব্যের নায়িকাকে বাস্তবের আলোকে পাঠকের সামনে এনে দাঁড় করায়। উদাহরণ স্বরূপ বীরাঙ্গনা শকুন্তলার পত্রিকার প্রথমাংশ অনায়াসেই উল্লেখ করা যায়—
বন-নিবাসিনী দাসী নমে রাজপদে
রাজেন্দ্র! যদিও তুমি ভুলিয়াছ তারে
ভুলিতে তোমারে কভু পারে কি অভাগী?
এই একোক্তিমূলক সংলাপ প্রবণতা বীরাঙ্গনা কাব্যকে গীতিকবিতা রূপে গড়ে তুলতে অনেকাংশে সহায়তা করেছে।
ইতিপূর্বে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর গীতিকাব্য রচনা করার নিখুঁত নিদর্শন বা প্রমাণ দান করেছেন আত্মবিলাপ, ব্রজাঙ্গনা বা মেঘনাদবধের চতুর্থ সর্গে। মধুসুদন ছিলেন বৈচিত্র্য প্রয়াসী। তাঁর রচনায় যেমন বিভিন্ন ধারা লক্ষ্য করা যায়, রচনা কৌশলেও তেমনি তিনি বৈচিত্র্যেরই সন্ধান করেছেন। তাই ব্রজাঙ্গনা বা মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ সর্গের রীতি অনুসারে গীতিকবিতা রচনা না করে বীরাঙ্গনা কাব্যে করলেন ভিন্ন রীতির অবলম্বন। নারী জীবনের নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিয়ে নারীর ব্যক্তিত্বের সমুজ্জ্বল মহিমা প্রকাশ করতে কাব্যরীতির Subjective ও Objective-এর সাযুজ্য ঘটালেন স্বীয় প্রতিভার প্রয়োগ কুশলতায়। ফলে প্রতিটি নায়িকার সাধ ও সাধ্যের সংঘাতে নাটকীয়তা অনিবার্য হয়ে উঠে তার ঘাত-প্রতিঘাতে উত্থিত আবেগ থেকে কাব্যে গীতিরসধারা নিঃসৃত হয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যকে বহুল্যাংশে গীতি কবিতার মর্যাদা দান করল।
কাহিনী বা ঘটনা সংঘটনের সঙ্গে মননঋদ্ধতাও গীতি কবিতার অন্যতম একটি লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। আমরা দেখেছি মননঋদ্ধতা বীরাঙ্গনা কাব্যে বর্তমান। বস্তুতঃ কোন রসের সার্থক প্রয়োগের জন্যে কাব্যে মননঋদ্ধতা সূচিত হয়। মধু কবির বীরাঙ্গনা কাব্য কবির আশ্চর্য নৈপুণ্যে নয়টি রসের সার্থক প্রকাশে সক্ষম হয়েছে। তার ফলে এবং কবির দার্শনিক দৃষ্টি ও চিন্তার ফলে বীরাঙ্গনা কাব্য অপূর্ব মননঋদ্ধ কাব্যে পরিণত হয়েছে। এইভাবে সব দিক থেকে বিচার করে দেখলে বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে কাব্যের ওড এবং লিরিক—এই দুই ধারার মধ্যে ওডের চেয়েও লিরিকের প্রাধান্যই বেশি লক্ষ্য করা যায়।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর