ভারতে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ
ভারতের ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সরকার এদেশে শিল্পের বিকাশ উত্তম গ্রহণ না করে ভারতকে বিলাতি পণ্যের বাজার ও কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে। অবশ্য ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বৃটেনের শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হলে ভারতের শিল্পায়নের সুযোগ আসে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটে, যেমন-
১. সুতিবস্ত্র
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ভারতের বস্ত্রশিল্পে যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ভারতীয় শিল্পপতিরা এই শিল্পের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ভারত বস্ত্র রপ্তানি ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বস্ত্র শিল্প মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ অন্তত ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোম বাড়িয়ে ৮৫টি এবং আমেদাবাদে ৪৯ টি কাপড়ের কল স্থাপিত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মোট ৩৩৫টি সুতো কলের মধ্যে ৩২২টি ছিল ভারতীয় মালিকানাধীন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বস্ত্র শিল্পে অন্তত ৪৬ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
২. লৌহ-ইস্পাত
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইংল্যান্ডের উৎপাদিত লোহা ও ইস্পাত ভারতের সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে সরকার ভারতে লৌহ ইস্পাত শিল্পে যথেষ্ট অগ্রগতি বিষয়ে উদ্যোগী হয়।
(১) জামশেদপুরের টাটা আইরন এন্ড স্টিল কম্পানি (TISCO) তে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে থেকে বিশুদ্ধ ইস্পাত উৎপাদন শুরু হয়। এই কোম্পানি ইস্পাতের উৎপাদনে ১৯১২-খ্রিস্টাব্দ ছিল ৩১ হাজার টন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কারখানা সম্প্রসারণ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই এই সংস্থার উৎপাদন ক্ষমতা ছিল আট লক্ষ টন।
(২) আসানসোলের এর কাছে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি (IISCO) প্রতিষ্ঠা হয়। এখানে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে উৎপাদন শুরু হয়।
(৩) এছাড়া এই সময় মহীশূর আয়রন এন্ড স্টিল ওয়ার্কস ৯২৩ খ্রিস্টাব্দে এবং কর্পোরেশন অব বেঙ্গল বেঙ্গল বেঙ্গল ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. পাট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পাট শিল্পে কিছু কিছু ভারতীয় মূলধন বিনিয়োগ শুরু হয়। ইতিপূর্বে গঙ্গা নদীর উভয় তীরে অসংখ্য পাটকল স্থাপিত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে গুলিতে উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
(১) ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাটকলের সংখ্যা ছিল ৬৪। ২ লক্ষ ১৬ হাজার কর্মী কাজ করতো। ১৯৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে পাটকলের সংখ্যা বেড়ে ধারায় ১১৩ টি।
(২) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের প্রয়োজন এ পাট জাত দ্রব্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। ১৯১৩-কত খ্রিস্টাব্দে ২ কোটি ৫ লক্ষ পাউন্ডের মূল্যে পাট এদেশে থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়। ভারতে পাটজাত দ্রব্যের অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা বাজারে বিপুল চাহিদা ছিল।
৪. বাগিচা শিল্প
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে চা, কফি, প্রভৃতি বাগিচা শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে।
(১) চা শিল্প : আসাম, বাংলা, কাছাড়, তরাই অঞ্চল, ডুয়ার্স, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব কাংড়া, দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি ও অন্যান্য অঞ্চলে চা শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের চা বাগিচার মোট আয়তন ছিল ৭ লক্ষ ৭ হাজার ৭৩৩ একর।
(২) কফি : দক্ষিণ ভারতে কর্ণাট, কেরালা ও তামিলনাড়ুতে যথেষ্ট কফি উৎপাদিত হতো। ১৯১০-বারো খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রায় ২ লক্ষ ৩ হাজার একর জমি কফি চাষ হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের সামরিক কফি রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে আরো উৎকৃষ্ট কফি উৎপাদন চাষীদের উদ্যোগে করে তোলে।
(৩) আখ : আখের উপর ভিত্তি করে ভারতে বিংশ শতকের সূচনায় চিনি শিল্প গড়ে ওঠে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের ৩০ টি চিনিকলে ১ লক্ষ ৫৮ হাজার টন চিনি উৎপন্ন হতো। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চিনি শিল্প সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া যায় তা সমৃদ্ধি হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের চিনি ফলের সংখ্যা ছিল ১৬১ টি।
৫. কয়লা
ভারতে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে রানীগঞ্জে সর্বপ্রথম কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়। ভারতের রেলপথ স্থাপন এবং লোহা ও ইস্পাত শিল্পের বিকাশের ফলে কয়লা শিল্পে যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। এই শিল্পের প্রধান বিদেশি পুঁজি প্রাধান ছিল। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন কয়লা খনি নিয়ে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান মাইনিং ফেডারেশন গড়ে ওঠ। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে মোট উৎপাদিত কয়লার প্রায় ৫.০৫ শতাংশ পূর্ব ভারতে কয়লা খনি গুলি থেকে উৎপাদিত হতো।
৬. কাগজ শিল্প
বিংশ শতকের প্রথম দিকে কাগজ শিল্পের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় এবং নতুন নতুন কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্য অন্যতম ছিল ভদ্রাবতীর মহীশুর পেপার ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে এবং হায়দ্রাবাদের শিরপুর পেপার মিল ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ভারতে ১৬ টি কাগজের কল ছিল। তাদের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২০ লক্ষ হন্দর।
৭. জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি একচেটিয়া আধিপত্য ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও সমুদ্র পরিবহনের ক্ষেত্রে ভারতীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। লোহা ও ইস্পাত এবং অন্যান্য ভারী শিল্পে প্রসার ঘটলে তার ওপর ভিত্তি করে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অগ্রগতি ঘটে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মালিকানায় সিনথিয়া নেভিগেশন কোম্পানি গড়ে ওঠে। বিশিষ্ট গুজরাটি শিল্পপতি ওলাচাঁদ হরিচাঁদ জাহাজ নির্মাণ সমুদ্র পরিবহনে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করেন।
৮. সিমেন্ট শিল্প
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের সিমেন্টের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ও বাড়ে। ভারতের সিমেন্টের উৎপাদন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ছিল ২ লক্ষ ৬৪ হাজার টন। এই উৎপাদন বেড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দাঁড়ায় ১২ লক্ষ টন। দশটি সিমেন্ট কোম্পানি একত্রিত হয়ে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাসোসিয়েট এর সিমেন্ট কোম্পানি গড়ে তোলে। শিল্পের পরিচালনা উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
উপরোক্ত শিল্প গুলি ছাড়াও আলোচ্য সময়কালে ভারতে চর্বি, পশম, মদ, দেশলাই, রাসায়নিক, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি শিল্পীর অগ্রগতি ঘটে। এছাড়া চাল, ময়দা, কাঠ , সোরা, আচ্ছা আমরা প্রবেশ প্রতিক্রিয়াকরণের জন্য বিভিন্ন যন্ত্র শিল্পের বিকাশ ঘটে। এ সময় ভারতীয় মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি ব্যাংক গড়ে ওঠে। এই ব্যাঙ্কগুলি ভারতে শিল্পস্থানে মূলধনের যোগান দেয়।