সূচনা
উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ভারতীয়রা এদেশে ব্রিটিশ শাসন কার্য অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নিজেদের দাবি ক্রমশ জোরদার করে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে সচিব জন মের্ল এবং বড়লাট লর্ড মিন্টো ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন সংস্কার আইন পাস করে তা মর্লে মিন্টো শাসন সংস্কার বা ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল লাইন নামে পরিচিত।
মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইনের পটভূমি
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে মিন্টো শাসন সংস্কার আইন প্রবর্তনের পটভূমি ছিল নিম্নরূপ-
১. ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের আইনের ত্রুটি
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনের ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভার মাত্র তিনজন মনোনীত সদস্যকে গ্রহণ করা হয়। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনে সরকারি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের বেসরকারি সদস্য হিসেবে ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ানো হয়। কিন্তু এই না আমার মাত্র সংস্কারে ভারতীয়রা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ঐতিহাসিক দীপাণ চন্দ্র এসব আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের হাতে অধিকার দানের ঘটনাকে একটি ধাপ্পাবাজি বলে অভিহিত করে। ভারতীয়রা আদর্শ বিরানব্বই খ্রিস্টাব্দে আইন সন্তুষ্টি না হয়ে তাদের হাতে বেশ ক্ষমতা প্রদান এবং শাসনকার্যে আরও বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে।
২. কংগ্রেসের প্রতিবাদ
জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক দাবী দাওয়া অন্যতম বিষয় ছিল ভারতীয় আইন পরিষদ বেশি সংখ্যক নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা এবং তাদের হাতে আরো বেশি ক্ষমতা প্রদান করা। এসব দাবিতে জাতীয় কংগ্রেস ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। পূর্বতন আইন গুলির মাধ্যমে যেহেতু আইন পরিষদে বেশিসংখ্যক নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণের সুযোগ ছিল না, সেহুত সরকার নতুন আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে থাকে।
৩. বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে দেশব্যাপী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সদস্য আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার সমস্যা সম্মুখীন হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র করে কংগ্রেসের চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটলে আন্দোলনে তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে সরকার বিপাকে পড়ে যায়।
৪. বিপ্লবী আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের একটি ধারা ক্রমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের পথ ধরে। বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত আন্দোলনের ফলে সরকার আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিপ্লবী আন্দোলন বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। সরকার এসব আন্দোলনের দুর্বল করার কথা ভাবতে শুরু করে।
৫. মুসলিম লীগের দাবি
ঢাকায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিজের নেতৃবৃন্দ মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনে দাবিতে সোচ্চার হয়। এ বিষয়ে তারা সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানায়। মুসলিম সম্প্রদায়কে খুশি করার কথা ভারত ভাবতে শুরু করে।
মর্লে মিন্টো শাসন সংস্কারের আইনের শর্তাবলী
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে-মিন্টো আইন বা কাউন্সিল আইনের প্রধান দুটি অংশ ছিল। ১. কার্য নির্বাহক পরিষদ ২. আইন পরিষদ।
১. কার্যনির্বাহক পরিষদ
মর্লে মিন্টো আইনের দ্বারা কেন্দ্রে ও বিভিন্ন প্রদেশে কার্যনির বাহক পরিষদের গঠনের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যেমন-
(১) ভারতীয় সদস্য গ্রহণ : বড়লাটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ এবং প্রতিটি প্রাদেশিক পরিষদে একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ করা হয়।। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদে প্রথম সদস্য হিসাবে সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ লর্ড সিনহা এবং প্রাদেশিক পরিষদে ভারতীয় সদস্য গ্রহণের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না হলেও বাংলার কার্যনির বাহক পরিষদের কিশোরীলাল গোস্বামী প্রবেশের সুযোগ দেন।
(২) সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি : বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাস প্রভৃতি প্রদেশের গর্ভনর এর কার্যনির্ভর পরিষদের সদস্য সংখ্যা দুজন থেকে বাড়িয়ে চারজন করা হয়।
২. আইন পরিষদ
মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা সরকারের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের গঠন ও ক্ষমতা বিষয়ক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেমন –
(১) সদস্য সংখ্যা : (i) কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়ি ৬০ জন করা হয়। এদের মধ্যে ২৮ জন সদস্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে থেকে নিযুক্ত হতেন, ২৭ জন সদস্য জমিদার শ্রেণী, মুসলিম সম্প্রদায়, বোম্বাই ও কলকাতার বণিক সভা এবং রাজেশ আইনসভা গুলির দ্বারা নির্বাচিত হতে এবং বাকি পাঁচজন সদস্যকে ভাইসরয় বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায় থেকে মনোনীত করতেন। (ii) সিদ্ধান্ত থেকে নেয়া হয়েছে প্রাদেশিক আইন পরিষদ গুলি সদস্য সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকবে এবং নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা তুলনায় মনোনীত সদস্যদের সংখ্যা সর্বদা বেশি থাকবে।
(২) বাজেট পরিকল্পনা : কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদ গুলি বাজেট তৈরি, বাজেট পাস, বাজেট সম্পর্কে আলোচনা করা ও ভোটদানের অধিকার পায়।
(৩) সুপারিশ করার ক্ষমতা : আইন সভা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা পায়।
(৪) পৃথক নির্বাচন : মুসলিম সম্প্রদায়কে পৃথকভাবে সদস্য নির্বাচনী অধিকার দেওয়া হয়।
(৫) অপসারণ : গর্ভনর জেনারেল ও প্রাদেশিক গর্ভনর তাদের অপছন্দের যে কোন সদস্যকে আইনসভা থেকে অপসারণের অধিকার পান।
উপসংহার
মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার ভারতীয় দের হাতে কিছু অধিকার দিলেও তা সামগ্রিকভাবে দেশের নেতৃবৃন্দকে খুশি করতে পারেনি। এই আইন পাশের পর থেকে ভারতীয়রা নিজেদের হাতে আরও বেশি পরিমাণ ক্ষমতা প্রদানের দাবি জানাতে থাকে। কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের কাজে ব্রিটিশ সরকার ভারতের অর্থ ও জনবল ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভব করে। তাছাড়া লক্ষ্মৌ চুক্তি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের মাধ্যমিক কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার নতুন একটি সংস্কার আইন প্রবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করে।