‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস
বহু সমালােচক, প্রায় এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা একখানি এপিকধর্মী নভেল। এই বক্তব্যের সার্থকতা নির্ণয় প্রসঙ্গে প্রথমেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা আবশ্যক গ্রন্থটির আয়তন ও গঠন বিন্যাসের দিকে। ছয়টি পর্বে, সাতাশটি অনুচ্ছেদে লেখা উপন্যাসটিকে অন্তত তিনটি উপকাহিনি যুক্ত হয়েছে। যেহেতু গ্রন্থের নাম ‘উপকথা’ তাই সুচাঁদ বুড়ির ভূমিকা কথকের বা সূত্রধরের মতো বারে বারে এসেছে। কাহার পাড়া তথা বাঁশবাদী গ্রামের ও কোপাই নদীর পুরাতন ইতিবৃত্ত সে শুনিয়েছে। উপন্যাসের মূল দ্বন্দ্ব বনওয়ারীর সঙ্গে করালীর। এ উপন্যাসের এটাই প্রতিপাদ্য—নতুন পুরাতনের দ্বন্দ্ব। এখানে তা অন্যরূপে প্রকাশিত। কৃষিনির্ভর গ্রাম জীবন কীভাবে যন্ত্র সভ্যতার গ্রামে নদী হচ্ছে তারই ট্র্যাজিক চিত্র এখানে চিত্রিত। তবে এক ক্ষুদ্র জনগােষ্ঠীর বিলােপকেই এখানে বড়াে ক্যানভাসে রূপ দেওয়া হয়েছে। মহাকাব্যে যেমন অদ্ভুত, অপ্রাকৃত বিষয় থাকে, তার প্রাচুর্য এখানে কম নেই। কর্তা বাবা কিংবা কালারুদ্রকে ঘিরে কাহার পাড়ায় ভয়, সভ্রাম ও বিস্ময় উল্লেখযােগ্য। সুচাদের বলা আলােকিক কথা বা পুরাণ কাহিনি ও কাহার জীবনের অমার্জিত রূপকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছে।
উপন্যাস মধ্যে লেখকের ক্রম মন্তব্যে ধরা পড়েছে কাহার সমাজের লােকবিশ্বাস-
- হাঁসুলী বাঁকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাত্রে কেউ শিস দিচ্ছে।.. শিস শুনে সবাই, ব্রয়মাদত্তি বেলবনের কর্তা তিনিই এইসব ঘটাচ্ছেন।
- ও যে আমার বাবাঠাকুরের বাহন রে। ওরই মাথায় চড়ে বাবাঠাকুরের যে ভেমন করেন।
- এ দুনিয়া আজব কারখানা…কাহার শােনে, ভাবে। আগে দেহের খাঁচায় অদেখা- অচেনা, পাখির কথা ভেবে কথাটা স্বীকার করত।
কাহারদের এমনই এক বিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত হানে করালী কর্তাবাবার অজগর সাপটিকে পুড়িয়ে মারে। ফলে দ্বন্দ্ব সংঘাত শুরু হয়, বনওয়ারী বনাম করালীর দ্বন্দ্ব এক গােষ্ঠী জীবনের কর্তৃত্বের যুদ্ধ ; আবার নতুন পুরানাের দ্বন্দ্ব। ঐতিহ্য সচেতন বনওয়ারী একা কুম্ভ হয়ে কাহারদের বিপন্ন প্রায় সংস্কৃতি, ধর্মবােধকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। যেমনভাবে উপন্যাসের শেষে উপকথার কোপাই মিশে যায় ইতিহাসের গঙ্গায়। নতুন এই হাঁসুলী বাঁকের কারিগর করালী। ফলে উপ্ত হয়েছে মহাকাব্যের বীজ।
এ উপন্যাসের লেখক দু’রকম কাহারদের কথা উল্লেখ করেছেন একদল পাল্কী বাহক, অন্যদল আটপৌরে অর্থাৎ সাহেবদের ভূত। কেউ কেউ চুরি ডাকাতি করে। বনওয়ারী কাহার দলের নেতা ও বীর। করালীচরণও সুবিধাবাদী, কিন্তু দুটি চরিত্রই সাহসে শক্তিতে, জৈব কামনায় উজ্জ্বল। বিশেষত বনওয়ারীর শেষ পরিণতি বড়াে করুণ। বজ্রাহত বনস্পতির মতাে সে ভুলুষ্ঠিত হয়েছে। নিজের স্ত্রী সুবাসীকে সে ধরে রাখতে পারেনি ; করালী নিয়ে গেছে। জীবনে ও সমাজে এভাবেই বনওয়ারীর ট্র্যাজিক পরাজয় ঘটে।
মূলত তারাশংকরের উপন্যাসে দাম্পত্য প্রেম সুখী ও সুন্দর নয়। এখানে গােপীমালা ও সুবাসীর সঙ্গে বনওয়ারীর প্রেম সার্থক হয়নি। করালী ও পাখির প্রেম ও চরিতার্থ হয়নি। কিন্তু বনওয়ারীর সঙ্গে কালােশশীর অবৈধ প্রেম অসফল হয়নি। স্বভাবে কালােশশী নত্র, নরম মনের। কিন্তু পাখি দুরন্ত স্বভাবের। সমাজ সংস্কারকে পরােয়া সে করেন না। জেদ করে করালীর সঙ্গে সে ঘর বাঁধে। কিন্তু সেই করালী যখন পরে সুবাসীকে আনে, সে আত্মঘাতিনী হয়। সুবাসী অনায়াসে স্বামী বনওয়ারীকে ছেড়ে করালীর বধু হয়েছে। অথচ রূপহীনা গােপীবালা কায়মনােকাব্যে বনওয়ারীর স্ত্রী হয়েই থেকেছে। প্রত্যাখ্যান অপমান সত্ত্বেও সে স্বামীকে ত্যাগ করেনি। ভালােবাসার এও এক স্মরণীয় চিত্র। অন্যদিকে পাগল তার নামের মতােই নিরাসক্ত, উদাসীন ও খেয়ালী। গান গেয়েই সে খুশী। গান গেয়েই কাহার পাড়াকে সে মাতিয়ে রাখে। বাঁশবাদির সঙ্গে যেন তার নাড়ীর যােগ। তাই চন্দনপুর এসে এই গ্রামকে গ্রাস করলো, নষ্ট করলে, সে সুচাদ বুড়ীর মতাে ব্যথিত, আর্ত হয়। পাগলের গানে, সুচাদের গল্পে শেষ পর্যন্ত কাহার পাড়ার আর তার সংস্কৃতি বেঁচে থাকে, যা হয়েছে মহাকাব্যোচিত।
সবশেষে বলতে হয় কেবল একটি উপন্যাসের কথাবস্তু গঠন ও পরিণতি মহাকাব্যিক হতে পারে না। কিন্তু যারা ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথাকে মহাকাব্যিক ভেবেছিলেন তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন, এই পর্বসংখ্যা ও পৃষ্ঠার বিস্তার। দেখেছিলেন ঘটনার ঘনঘটা, চরিত্রের ভিড়, মিথ পুরাণ লােককথার ব্যবহার। আদ্যন্ত অসংহত, শিথিল বন্ধ হয়েও এই উপন্যাসকে মহাকাব্যের ছাঁচে ফেলেছেন অজিত কুমার ঘােষ। তাঁর মতে, মহাকাব্যের মধ্যে যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ঘটনা। অনেক প্রসঙ্গ থাকে, এ উপন্যাসের ও সেরূপ। রয়েছে। মহাকাব্যের মধ্যে যেমন কোনাে জাতি বা গােষ্ঠীর সামগ্রিক রূপই উপস্থাপিত হয় ; এ উপন্যাসেও সেই সামগ্রিক জনকাহিনিই উপস্থাপিত হয়েছে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের মেনে নিতে দ্বিধা নেই বহু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও ‘হাঁসুলী বাঁকে উপকথা’ উপন্যাসখানি মহাকাব্যিক পদমর্যায় উন্নীত।