‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসের বীরভূম অঞ্চলের কোপাই নদী সংলগ্ন বাঁশবাদী গামের ‘কাহার গােষ্ঠীর’ অন্তরঙ্গ জীবনকথা বলার জন্য লেখক যে প্লট নির্মাণ করেছেন তার মুখ্য অবলম্বন গ্রামের মাতব্বর বনওয়ারী ও নবীন যুবা করালীর বােধ- বিশ্বাস জনিত বৈপরীত্যের টানাপােড়েন। বস্তুত, সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত উপন্যাসের কাহিনি বৃত্ত এদের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হতে হতেই সম্পূর্ণতা লাভ করেছে।
কাহারদের বহুকালগত জীবন সংস্কৃতির প্রতিনিধি পুরুষ বনওয়ারীর সঙ্গে নিরন্তন সংঘাতে অনেকখানি আধুনিক যুক্তিবুদ্ধি সাহসের যুবা-প্রতিনিধি করালী স্পষ্টতই ব্যক্তিতে একটা বিশেষ উচ্চতায় পৌছে গেছে। করালীর লড়াইটা বনওয়ারীর থেকে অনেকটাই কঠিন। কারণ বনওয়ারী তার পাশে পেয়েছে প্রায় গােটা কাহার পাড়াকে। অন্যদিকে গুটিকয়েক মানুষের হালকা সমর্থন সম্বল করে করালী প্রায় একাই লড়ে গেছে। শুধু তার স্বজনদের সঙ্গেই নয়, সেই সঙ্গে ক্ষমতাবান মালিক মহাজনদের ক্রোধানলের সামনে ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে। বস্তুত, নবীন প্রবীনের দ্বন্দ্ব-কেন্দ্রিক উপন্যাস কাহিনিতে সবচেয়ে কঠিন লড়াইটা করালীকেই লড়তে হয়েছে। করালীর লড়াকু মেজাজের অনন্যতা উপন্যাসের সূচনা থেকে দেখা যায়।
বনওয়ারীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে করালী কখনােই ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা চালিত হয়নি। মাতব্বর হিসাবে বনওয়ারী গােটা কাহার পাড়াকে যেভাবে অলৌকিক বিশ্বাসের অব্ধকূ পে নির্বাসিত করে রাখতে চায়। যেভাবে অর্থবান মালিক মহাজনদের শােষণের জাঁতাকলে আটকে থাকায় উৎসাহিত করেকরালীর জেহাদ সে সবের বিরুদ্ধে। মাতব্বর হিসাবে বনওয়ারীই তার অনুগামীদের নিয়ে করালীর চলার পথে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। ঘরে শত্রুর সঙ্গে লড়াইটা সবচেয়ে কঠিন। না হলে বিদেশি শােষক কাবুলীওয়ালার সঙ্গে লড়াইয়ে সহজেই সে জিতে যায়। তাইতাে ঘােষদের অন্যায়ের জবাব দিতেও তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। ভদ্রলােকদের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণের অপমান কিংবা কেরােসিন নিয়ে তাদের কারচুপির যােগ্য জবাব দিতে ও প্রতিবিধান করতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক চিরন্তন কলঙ্ক। গৃহশত্রুর বিড়ম্বনায় কত মহৎ প্রচেষ্টাই যে বিনষ্টির বেদনায় রক্তাক্ত হয়। প্রতিবাদী করালীর সংগ্রামী প্রয়াসও এমনিভাবে মাতব্বর বনওয়ারীর অন্ধ সংস্কার ও অহংকারের দুয়ারে বারবার মাথা কুটে কুটে রক্তাক্ত হয়েছে। তবু সে থেমে থাকেনি। থামানাে যায়নি তাকে।
আপন পৈতৃক ভিটায় পাকাঘর ও তােলার জন্য মাথলা ও নটবর যখন মাতব্বর বনওয়ারীর অনুমতি নেওয়ার প্রসঙ্গ তােলে, তখন করালীর দৃপ্ত উচ্চারণ- “মাতব্বর কে রে ? আমার মাতব্বর আমি।” এই আত্মদীপ্ত পৌরুষ নিয়ে স্বভূমিকে সর্বপ্রকারের অন্ধকার থেকে আলাের ঠিকানায় পৌছে দেবার প্রয়াসে করালী তার গ্রামের মাটিকে আঁকড়ে ধরে থেকেছে। সমগ্র কাহার পাড়া একসাথে তাকে এখান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। ধীরে ধীরে অনেকেই তার অনুগামী হয়েছে। অনেকে তাকেই অনুসরণ করার কথা ভেবেছে। স্বগ্রামের মাটিতে করালীর অবস্থান ক্রমশঃ মজবুত হয়েছে। সুতরাং করালীর গ্রামে ফেরা অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ ঘটনা। আসলে জীবনের প্রবাহ তাে থেমে থাকে না। অথচ কথাকারকে একটা জায়গায় থামতেই হয়। জনেজনে পৌছে। দিতে হয় অনুভবের শেষ বার্তাটি। তাই করালীর সবল হাতে তুলে দিতে হয় গাইতি। এবং হাঁসুলী বাঁকের মাটিতে তার খননকার্য দেখিয়ে বলতে হয়- “উপকথার কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার পর কাটছে নতুন হাঁসুলী বাঁক।”
বস্তুত, কাহার গােষ্ঠীর নতুন নায়ক করালীর জীবনকথার এটাই তাে প্রত্যাশিত পরিণতি। আত্মচেতনায় দৃ্ত করালীর বহুবিধ কর্মকাণ্ডে বনওয়ারীর পরাভাব ক্রমশঃই স্পষ্টতা পাচ্ছিল। সুবাসীকে কেন্দ্র করে করালীর সঙ্গে চরম সংঘাতে বনওয়ারীর চুড়ান্ত পরাজয়ের ঘটনা ওই পরিণতির পথটিতেই প্রশস্ত করেছে। মৃত্যুর পূর্ব বনওয়ারী জেনে গেছে, জঙ্গলের ঘােষদের সঙ্গে সঙ্গে চন্দনপুরের বাবুরাও তার সহেবডাঙার সব জমি কেড়ে নিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। কাহার পাড়ার মানুষগুলি করালীর নেতৃত্বে চন্দনপুরের কারখানায় শ্রমিকের কাজে যােগ দিয়েছে। মহাজনী শােষণের ফাঁস থেকে কাহারদের মুক্তির চিন্তা ও চেতনার জাগরণে করালীর নিরলস লড়াই এইভাবে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যভূমির খুঁজে পেয়েছে।
হয়তাে গ্রামীণ মহাজনী শােষণের নাগপাশ থেকে তারা ঔপনিবেশিক শােষণের বিস্তৃত জগতে প্রবেশ করেছে-কিন্তু তাই বলে করালীর প্রতিবাদী সংগ্রাম মূল্যহীন হয়ে যায় না। কারণ এটাই ইতিহাসের বাস্তবতা। শােষণমুক্তির ইতিহাস তাে এভাবেই একটা পর্ব থেকে অন্যপর্বে উত্তরিত হয়ে যায়। অন্যতর সেক শােযণ-সাম্রাজ্যের বুকেও নবতর চেতনার মশাল জ্বেলে দৃপ্ত চরণে হেঁটে বেড়াবে করালীরা। শুরু হবে নতুন লতাই এবং এভাবেই প্রতিবাদী চেতনায় দীপ্ত করালীদের অবিরাম লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই হয়তাে একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বপ্রকারের শােষণ মুক্ত মানব সমাজের সুনির্মল সভ্যতা।
‘করালী’র কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার প্রথম-প্রযত্নে তারাশঙ্করের এই প্রগতি চিন্তাই ফুটে উঠেছে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় ঔপন্যাসিকের এই বিশিষ্ট জীবনবােধের বার্তাবহ করালীর নায়ক চরিত্রের ওই ইতিহাস-অনুসঙ্গ একটা বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই সবমিলিয়ে বলতে হয় কাহার সমাজের মাতব্বর হিসাবে বনওয়ারী উপন্যাস মধ্যে নায়ক পদবাচ্য বলে মনে হলেও সংগ্রামী নায়ক হিসাবে করালীর মহিমা ও কার্যকারিতা অটুট।