সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার প্রবন্ধটিতে বিবেকানন্দের রচনা-বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে
স্বামী বিবেকানন্দের অভিজ্ঞতার বৃত্তান্ত পরিব্রাজক গ্রন্থের সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনাটি পত্রাকারে রচিত হলেও একে ভ্রমণ বিবরণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। রচনাংশটিতে সুন্দরভাবে হাঙর শিকারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই রচনাটিতে লেখক হাঙর ধরার নির্ধারিত বড়শিটির উপমা দিয়েছেন কুয়াের ঘটি তােলার ঠাকুরদাদা বলে। আবার, সমুদ্রের জলে সেই বড়শিটার চারদিকে বাঁধা থাকা শুয়ােরের মাংসের টোপ-এর বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, তা যেন জলের মধ্যে, রঙ-বেরঙের গােপীমণ্ডলমধ্যস্থ কৃয়ের ন্যায় দোল খাচ্ছে। এইভাবে সমগ্র রচনাটিতে লেখক সফলভাবে নানান উপমা প্রয়ােগ করেছেন।
আলােচ্য পাঠ্যাংশে স্বামী বিবেকানন্দ বিভিন্ন মাছের এবং দুটি হাঙরের যথাযথ ও সুন্দর বর্ণ দিয়েছেন। দুটি আলাদা হাঙরের যথাক্রমে বাঘা এবং থ্যাবড়া নামকরণের মধ্যেও আমরা তার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাই। লেখক হাঙর চোষক মাছের এবং তার চোষক-যন্ত্রের যেমন নিপুণ বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনি তার চোষকযন্ত্রের কার্যকারিতা পা দিয়ে চেপে পরীক্ষাও করেছেন। তা ছাড়াও বড়শি, ফাতনা, টোপ, হাঙরের নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদিরও যে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন, তা তাঁর পর্যবেক্ষণশক্তিরই পরিচায়ক।
এইভাবে, আলােচ্য রচনাটি লেখক এমন সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করেছেন যে, সুয়েজখালে স্বামীজির পাশে দাঁড়িয়ে পাঠকরাও যেন রেলিং-এ ঝুঁকে হাঙর-শিকার দেখছেন।
সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় বিবেকানন্দের ভাষাশৈলীর পরিচয় দাও।
ভাষাভঙ্গির দিক থেকে বিশেষত, বাক্-নৈপুণ্য এবং চলিত ভাষা প্রয়ােগের ক্ষেত্রে বিবেকানন্দ সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় আশ্চর্য আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
আলােচ্য রচনাতে দেখা যায়, একদিকে লেখক যেমন সমাস বা সন্ধিবদ্ধ তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন, অন্যদিকে তেমন স্থান পেয়েছে প্রচুর ইংরেজি ও উত্তর কলকাতার কথ্যবুলি। শুরুতেই দেখা যায়, লােহিত সাগরের বদলে তিনি ব্যবহার করেছেন ইংরেজি ‘রেড সী’শব্দ। এরপর ব্যবহার ঘটে একের পর এক দেশি শব্দের, যেমন -ন্যাটা’, আলটপকা’, ফাঁড়া’, চিপসে’, চোচা দৌড়, পাছার উপর, ‘শােরের মাংস’ প্রভৃতি। এর পাশাপাশি প্রচুর তৎসম শব্দকেও অনায়াসে লেখক রচনায় স্থান দেন, যেমন পরিবেষ্টিত, ‘কড়িকাষ্ঠরূপ’, ইত্যাকার, কর্ণকুহর’, ‘চক্রাকার, আকটিদেশ-বিস্তৃত প্রভৃতি। ব্রিয়াপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উত্তর কলকাতার লােকের উচ্চারণের প্রভাব। তাই যাচ্ছে বা হচ্ছে র বদলে তিনি ব্যবহার করেন যাচ্চে বা হচ্চে। একটি মজলিশি ছোঁয়াও বিবেকানন্দের রচনায় লক্ষ করা যায়। পাঠককে যেন শ্রোতা বিবেচনা করেই তিনি লেখেন, ব্যাস্-দশ দিন কারাঁটীন (quarantine)। এভাবে ইংরেজি, দেশীয় বা লােকায়ত শব্দ এবং কথ্যবুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিবেকানন্দ রচনায় ব্যবহার করেছেন।
হাস্যরসাত্মক রচনা হিসেবে ‘সুয়েজখালে : হাঙ্গার শিকার কতখানি সার্থক?
স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের অন্তগর্ত সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় প্রধান চার প্রকার কৌতুক রসেরই মিশ্রণ ঘটেছে।
স্বামীজি যখন বলেন, “মালদ্বীপ হতে উনি (বনিটো মাছ) শুটকূিপে আমদানি হন হুড়ি চড়ে-” তখন তাঁর এই সম্মান প্রদর্শনের ঘটা হয়ে যায় পান (Pun) বা শব্দ-কৌতুকের উজ্জ্বল উদাহরণ।
হাঙরদর্শনে উদগ্রীব জাহাজসুদ্ধ যাত্রীর বর্ণনায় লেখক বলেছেন, “শ্রীহাঙ্গরের জন্য ‘সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পদ্থানং হয়ে রইলাম; এবং যার জন্যে মানুষ ঐ প্রকার ধড়ফড় করে, সে চিরকাল যা করে, তাই হতে লাগলাে— অর্থাৎ সখি শ্যাম না এল’।” এই বর্ণনায় আমরা উচ্চমানের হিউমার অর্থাৎ স্মিত কৌতুকের পরিচয় পাই।
স্বামীজি দুই হাঙরের কাল্পনিক কথােপকথন আলােচনা করার পর যখন বলেছেন, অথবা ‘বাঘা মানুষ-ঘেঁষা হয়ে মানুষের ধাত পেয়েছে, তাই থ্যাকে আসল খবর না বলে, মুচকে হেসে, ভালো আছ তাে হে বলে সরে গেল। আমি একাই ঠকবাে?” তখন বােঝা যায়, মনুষ্যচরিত্রকেও কটাক্ষ করতে তিনি ছাড়েননি। এসবই স্যাটায়ার বা বিদ্রুপাত্মক কৌতুকের সার্থক উদাহরণ।
লেখক আড়কাটী মাছ বা পাইলট ফিশের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, “তারা হাঙরকে শিকার দেখিয়ে দেয় আর বােধ হয় প্রসাদটা-আসটা পায়।এসবই উইট অর্থাৎ বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকের সার্থক উদাহরণ।
সুতরাং সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনাটিকে আমরা নিঃসন্দেহে একটি উচ্চমানের হাস্যরসাত্মক রচনা বলতেই পারি।
স্বামী বিবেকানন্দের সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করাে।
স্বামী বিবেকানন্দের ‘সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার’ রচনাটি বিষয়ভিত্তিক নামকরণের একটি আদর্শ উদাহরণ। কাহিনির ভূমিকায় সুয়েজ বন্দরে জাহাজের অবস্থানের কারণ বর্ণনা করে অত্যন্ত দ্রুত সুয়েজ বন্দরে হাঙরের আধিক্য এবং সে বিষয়ে তাঁর ও অন্যান্য যাত্রীদের আগ্রহের কথা জানিয়ে এই পর্বের সূচনা করেন লেখক। এরপর রয়েছে হাঙর শিকারের প্রস্তুতি-পর্ব। কীভাবে বড়শি জোগাড় করে তাতে কাছি বাঁধা হল, ফাতনা হিসেবে বাঁধা হল কাঠের টুকরাে, পাহারাদার আরব পুলিশের সাহায্য নেওয়া হল সেই ফাতনা দূরে ফেলার জন্য, প্রবল উত্তেজনার কারণে বাঘা হাঙর শিকারের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এল, তারপর থ্যাব্ড়ামুখাে হাঙরের আগমন, তার টোপ গেলা এবং তাকে শিকার করা—কৌতুক আর নাট্যরসের অসামান্য মিশ্রণে এই আপাত তাৎপর্যহীন ঘটনাও পাঠককে আকর্ষণ করেছে। হাঙর শিকার অভিযানের পর এই রচনাতে বর্ণিত হয়েছে। সুয়েজখালের বর্ণনা এবং সেই সূত্রে পৃথিবীর ব্যাবসা বাণিজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং সেক্ষেত্রে ভারতবর্ষের অবদানের কথা। রচনাটির সম্পূর্ণ অংশ জুড়ে এভাবে সুয়েজখাল তৈরির ইতিহাস, সেই খালের ব্যবহার ও কার্যপ্রণালী এবং সর্বোপরি সেই খালে হাঙর শিকারের কাহিনিটি বর্ণিত হওয়ায় আলােচ্য রচনাটির নামকরণ যে একেবারে সার্থক হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় বলা চলে।