স্বত্ববিলোপ নীতি কি? এই নীতির প্রধান শর্ত গুলি কি ছিল? স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ উল্লেখ করো? লর্ড ডালহৌসি অন্য কোন কোন উপায় ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটার?

সুচনা

লর্ড ওয়েলেসলির পরবর্তীকালে ভারতের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যবাদের শাসক ছিলেন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি, ১৮৪৮-১৮৫৬ খ্রিস্টাব। ঐতিহাসিক স্যার রিচার্জ টেম্পল বলেছেন যে, “ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের মধ্যে ডালহৌসি সমকক্ষ আর কেউ ছিল না।” ঐতিহাসিক ইনেস বলেছেন যে, ডালহৌসি পরবর্তী শাসকরা পারদপক্ষে যুদ্ধ বা রাজ্য দখল এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ডালহৌসি সর্বদা রাজ্য দখলের সুযোগ খুঁজতে। ডালহৌসীর আমলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বাধিক প্রসার ঘটে।

স্বত্ববিলোপ নীতি

ভারতের বড়লাট লর্ড ডালহৌসি যেসব নীতি অবলম্বন করে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটান সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল স্বত্ববিলোপ নীতি। এই নীতি অনুসারে তিনি ব্রিটিশ কোম্পানির দ্বারা সৃষ্টি দেশীয় রাজ্যগুলির অপত্রক রাজাদের দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার নাচক করেন। তাই সেই রাজার মৃত্যুর পর তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর স্বত্ব বা অধিকার বিলুপ্ত হয়। ফলে সেই রাজ্যটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হতো।

স্বত্ববিলোপ নীতির শর্তাবলী

লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত স্বত্ববিলোপ নীতির প্রধান শর্তাবলী অনুসারে –

১. দেশে রাজ্যগুলির শ্রেণীবিভাগ

ডালহৌসি ভারতে দেশীয় হিন্দু রাজ্যগুলিকে প্রধান তিন ভাগে বিভক্ত করেন, যথা-

(১) কোম্পানির দ্বারা সৃষ্টি দেশীয় রাজ্য।

(২) কোম্পানির আশ্রিত বা অধীনস্থ করদ রাজ্য এবং

(৩) স্বাধীন দেশের রাজ্য।

২. কোম্পানি দ্বারা সৃষ্টি দেশীয় রাজ্য

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা সৃষ্টি কোন দেশীয় রাজ্যের রাজার পুত্র সন্তান না থাকলে সেই রাজার কোনো উত্তরাধিকারী বা দত্তপুত্রক গ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে রাজার মৃত্যুর পর সিংহাসনে উত্তরাধিকারী অভাবে সেই রাজ্য ব্রিটিশ শাসনভুক্ত হবে।

৩. কোম্পানির আশ্রিত করদ রাজ্য

কোম্পানির আশ্রিত করদে রাজ্যের রাজারা কোম্পানির অনুমতি নিয়ে দত্তক সন্তান গ্রহণ করতে পারবে। তবে কোম্পানি সেই দেশীয় রাজাকে দত্ত গ্রহণের অনুমতি না দিলে রাজার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হিন্দ রাজ্যটি কোম্পানির অধিকারে চলে যাবে।

৪. স্বাধীন দেশে রাজ্য

স্বাধীন দেশে রাজ্যগুলির উত্তরাধিকার সম্পর্কে সরকার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন না।

স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ

লর্ড ডালহৌসি আগে মুন্ডাভি ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে, কোলাবা ও জলায়ুন ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এবং সুরাটে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ হয়। তবে ভারতের সর্বপ্রথম ডালহৌসি এই নীতির কঠোরভাবে প্রয়োগ করে বিভিন্ন দেশে ও রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভুক্ত করেন এবং কয়েকজন দেশীয় রাজার পদ্ম মর্যাদা বাতিল করেন, যেমন-

১. রাজ্য অধিকার

ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতির মাধ্যমে সাতারা ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে, জয়েৎপুর, সম্বলপুর, বাঘাট ও ভগৎ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে, উদয়পুর ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে, করোলা, ঝাঁসি ও নাগপুর ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতি রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভুক্ত করেন।

২. রাজার মর্যাদা বাতিল

স্বত্ববিলোপ নেটের প্রয়োগ করে ডালহৌসি কয়েকজন দেশীয় রাজার পদমর্যাদা ও ভাতা বাতিল করে। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও এর মৃত্যুর ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের পর তার দত্তপুত্র নানা সাহেবের বৃত্তি ও পেশোয়া উপাধি বাতিল করা হয়। কর্ণাটকের অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে।

অন্যান্য উপায়ে ডালহৌসির সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ

ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নিজের প্রয়োগ ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি উপায় ভারতে বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজ্যকে দখল করেন এবং সেখানে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই উপায় বা পন্থা গুলি হল-

১. যুদ্ধের দ্বারা রাজ্য জয়

ডালহৌসি দ্বিতীয় ইঙ্গ- শিখ যুদ্ধে জয়লাভ করে পাঞ্জাব ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে, দ্বিতীয় ইঙ্গ ব্রহ্ম যুদ্ধে জয় লাভ করে দক্ষিণ ব্রহ্মা, আরাকান ও তেনাসেরিম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

২. কু শাসনের অজুহাতে রাজ্য গ্রাস

কুশাসনের অজুহাতে ডালহৌসি অযোধ্যা রাজ্যটি দখল করে নেন এছাড়াও লর্ড ডালহৌসি অন্যান্য কিছু অজুহাতে সিকিমের একাংশ ও হায়রাবাদের বেরার প্রদেশটি দখল করেন।

উপসংহার

লর্ড ডালহৌসি লগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে ভারতের সুবিস্তিত অঞ্চলের ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ডালহৌসির ঘোর তো রাগরা আসুন শেষ পর্যন্ত দেশীয় রাজাদের মনে আতঙ্ক ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই অসন্তোষ এর অন্যতম প্রত্যক্ষ ফল ছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ বিরোধী মহাবিদ্রোহের বিভিন্ন দেশীয় রাজা ও রাজার দত্তক পুত্রদের যোগদান।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment