কবির মনোজগতে অনেক সময় এমন সব ভাবনা-চিন্তার উদয় হয় যেগুলিকে সহজভাবে প্রকাশ করা যায় না; করার চেষ্টা করলে, সেগুলি পাঠক-পাঠিকাদের কাছেই যে কেবল দুর্বোধ বলে মনে হয় তা নয়, কবি নিজেও কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করেন। নিজের চিন্তাকে বহুমনের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েই কবিকে রূপকের আশ্রয় নিতে হয়। সেই চেষ্টারই ফসল-রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা।
এখানে রবীন্দ্রনাথ যে রূপকটি গ্রহণ করেছেন সেটি হচ্ছে একটি কৃষক আর একটি মাঝির রূপক। কঠোর পরিশ্রম করে চাষিটি মাঠে চাষ করেছে। সোনার ধানে ভরে গিয়েছে তার মাঠ ; সেই ধান কেটে নদীর ধারে চাষিটি চুপ করে বসে রয়েছে নৌকার আশায়। সেই নৌকাতে চাপিয়ে তার সোনার ধানগুলিকে সে ঘরে বয়ে নিয়ে গিয়ে তার নিজের মরাই এর মধ্যে রেখে দেবে। এতেই তার আনন্দ।
নৌকার আশায় নির্জন নদীর কূলে একা বসে-বসে চাষিটি যখন হতাশ হয়ে পড়েছে এমন সময় হঠাৎ তার চমক ভাঙল। সে দেখল একজন মাঝি মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে সোনার তরী বেয়ে তারই দিকে এগিয়ে আসছে। চাষিটির মনে হল মাঝিটিকে সে চেনে ; কিন্তু মাঝির চোখে মুখে তাকে চেনার কোনো চিহ্নই ফুটে ওঠেনি। তবু তার কাতর আহ্বানে সে তীরে নৌকা ভিড়াল; গভীর আনন্দে চাষিটি তার সব ধান সেই নৌকায় তুলে দিল। আশা ছিল মাঝিটি তাকেও তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু মাঝির সাফ জবাব এল, ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী’। আর হতভাগ্য চাষি ? তার সমস্ত পরিশ্রমের ফসল নৌকার ওপর তুলে দিয়ে শূন্য নদীর চরে একা রইল পড়ে। চাষিটির আর্তনাদ শূন্য নদীর তীরে নিজেকে কেন্দ্র করেই মূর্ছাহত হয়ে পড়ল।
এখানে কবিই হচ্ছেন সেই চাষি যিনি সমস্ত জীবনে ধরে তাঁর কাব্যখেতে ফসল ফলান। আর মাঝিটি হচ্ছে মহাকল। মানুষ কাজ করে ; সে ভাবে সুকর্মের জোরে বিশ্বের মধ্যে সে একটা নাম রেখে যাবে। কিন্তু তা হয় না। মানুষের কাজটাই জগত গ্রহণ করে, মানুষকে নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘সংসার আমাদের জীবনের সমস্ত কাজ গ্রহণ করে না। আমাদের চিরজীবনের ফসল যখন সংসারের নৌকায় বোঝাই করিয়া দিই তখন মনে আশা থাকে যে আমারও এই সঙ্গে স্থান হইবে; কিন্তু সংসার আমাদিগকে দুই দিনেই ভুলিয়া যায়। তুলে না গিয়ে উপায় কী? সংসারে এত স্থান কোথায় যে শত লক্ষ কোটি মানুষকে তার স্মৃতির যাদুঘরে স্থান দেবে? সুতরাং সোনার তরীতে কবির জন্যে যে স্থান হবে না তা তো জানা কথা। কিন্তু কবির মনতো তা বোঝে না। মহাকালরূপ মাঝি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল দেখে কবির আত্মা আর্তনাদ করে উঠল। তিনি বিমর্ষ চিত্তে বলে উঠলেন :
শ্রাবণগগন ঘিরে ঘন/মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে/রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
এ শুধু কেবল কবিরই নিজস্ব আর্তনাদ নয়; এ হচ্ছে মানবাত্মার আর্তনাদ। মানুষের ব্যর্থ দম্ভের আর্তনাদ। ফসল আমার আমাকে বাদ দিয়ে আমার ফসল নেওয়া চলবে না; কিন্তু মহাকাল উদাসীন। মানুষের ওপরে তার বিন্দুমাত্র লোভ নেই ; লোভে তার মানুষের কর্মের ওপরে। গীতাতেও এই কথাটাই বলা হয়েছে; তুমি কাজ করে যাও ; ফলের প্রত্যাশা কোরো না। এই নিরাসক্তিই কর্মীকে কর্ম করার প্রেরণা জোগায়।
‘সোনার তরী’ কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ একটি রূপকের মাধ্যমে সেই কথাটিই ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। শূন্য নদীর চর, বিপুল তাঁর নিঃসঙ্গতা ; কাঁধের ওপরে সোনার ফসলের বোঝা ; আধো চেনা মাঝি, আর সোনার তরী। কিন্তু বোঝা হালকা না করলে তো মানুষের চলে না। যদিও কবিতাটির মধ্যে কবিমনের একটি করুণ আর্তিই প্রকাশ পেয়েছে, তবু তাঁর বোঝা হালকা হওয়ার জন্যে একটা স্মৃতির নিঃশ্বাসও যে পড়েছে সেটা বুঝতেও আমাদের অসুবিধে হয় না। কবি বুঝেছেন তাঁর ফসল বিশ্ববাসীর, মহাকাল যার রূপক। তাঁর শ্রমের ফসল তাঁর নয়। তাঁর রোদন বৃথা, হাহাকার তাঁর ব্যর্থ।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর