‘সোনার তরী’ কবিতাটির অর্ন্তনিহিত তত্ত্ব নানাভাবে ব্যাঘাত হয়েছে সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করো। তত্ত্বকে অতিক্রম করে এই কবিতাটি কতখানি রসোতীর্ণ হয়েছে সে বিষয়ে তোমার মতামত ব্যক্ত করো।

‘সোনার তরী’ কবিতাটি একটি ‘তত্ত্বাশ্রয়ী কবিতা

রবীন্দ্রজীবনীকার শ্রদ্ধের প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মানসী’ কাব্য গুচ্ছের শেষ কবিতা রচনার প্রায় পনেরো মাস পরে শিলাইদহে কবি লিখেছেন ‘সোনার তরী’ (১২৯৮ ফাল্গুন) যদিও উহা লোকচক্ষুর গোচর হয় প্রায় দেড় বৎসর পরে। কী কুক্ষণে তিনি যে কবিতাটি লিখিয়াছিলেন তাহা তাহার ভাগ্য বিধাতা জানেন। নইলে এই কবিতা লিখিত হইবার পর প্রায় চৌদ্দ বৎসর পরে ইহাকে কেন্দ্র করিয়া বাংলার সাময়িক সাহিত্য যে পরিমাণে রস ও বিষ নিষ্কাশিত হইয়াছিল, তাহা রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি কবিতা সম্বন্ধে পূর্বে বা পরে কখনও হয় নাই। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি রচনার প্রায় সতের বৎসর পরে অর্থাৎ বিতর্ক আরম্ভ হওয়ারও থেকে কিছু পরে নিজেও একটা ব্যাখ্যা দেন। তাতে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের ক্ষেতটুকু দ্বীপের মতো, চারদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত, ওই একটুখানিই তার কাছে ব্যর্থ হয়ে আছে। যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারদিকের জল বেড়ে উঠছে, যখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ওই চরটুকু তলিয়ে যাবার সময় হ’ল, তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু নিত্য ফল তা সে ওই সংসারের তরুণীকে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নেবে, একটা কণাও ফেলে দেবে না—কিন্তু যখন মানুষ বলে ‘ওই সঙ্গে আমাকেও নাও’, ‘আমাকেও রাখো’, তখন সংসার বলে, ‘তোমার জন্য জায়গা কোথায়? তোমাকে নিয়ে আমার হবে কি? তোমার জীবনের ফসল যা কিছু রাখবার তা সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি’ত রাখার যোগ্য নও।”

কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার ‘সোনার তরী’ কবিতার কোন্ কোন্ সমালোচকের কিছু কিছু মন্তব্য আংশিক ভাবে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন। কারও কারও মতে কবিতাটি শুধু দুর্বোধ্য নয়, অর্থহীনও। শ্রাবণ মাসে কোথাও ধান পাকে না, কেউ সে সময়ে ধান কাটেও না। সোনার ধান নেই, সোনার তরীতে কোনো চাষি ধান কাটতে যায় না। পালে ভর করে যখন নৌকা চলে তখন দাঁড়টানা হয় না। তাই সে সময় ‘তরী বাওয়া’ কথাটা অবাস্তব। আবার কোনো কোনো সমর্থক সমালোচক ‘সোনা মুখী’ চালের কথা শুনিয়ে বললেন যে, ধান এরূপ সময়েই কাটা হয়। সাহিত্য সমালোচনা সমর্থক ও বিরোধীদলের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছিল।

মোহিতলাল বলেন যে, কবিতাটিতে শুধু রস সৃষ্টিই নয়—একটা অর্থও আছে। কবি হৃদয়ের একটা বিশেষ অনুভূতি কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি আরও বলেন “রচনার দোষ বা গুণ এই যে, উহাকে একটা রূপকের ঠাঁই আছে—অথচ সেই রূপক সর্বাংশে একটা রূপ হইয়া উঠে নাই। কবি মানসের একটা ভাবময় situation বা অন্তর সঙ্কট। বাহিরের ভাষায় নটীকৃত হইতে চাহিয়াছে কিন্তু সেই ছবিও ছবি না হইয়া ইঙ্গিতময় হইয়াছে—ছবির দিক দিয়াও একটা পৃথক অর্থ সম্পূর্ণতা উহাতে নাই।”

কবি একটা চরের মধ্যে একদা পদ্মার জল ঢুকতে দেখলেন। দেখেছিলেন সে সময় বিষণ্ণ মুখে কৃষকেরা কাঁচা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে নৌকা ভরে। চাষিদের সেই ট্র্যাজেডির কথা কবির মনে ছিল। এই ঘটনাকে ভিত্তিমূলে রেখে অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী ‘সোনার তরী’ কবিতাটি বুঝবার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, “সোনার তরী প্রারম্ভে-অবস্থিত হইয়া কবির মানব-প্রীতির সুরটি ধরাইয়া দেয়।”

অধ্যাপক বিশী কবিতাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন : কবি তাহার এক আঁটি সোনার ধান লইয়া নিজের জীবনের ক্ষুদ্র ঘাটটিতে ক্ষুদ্রতর অভিজ্ঞতার দ্বারা বেষ্টিত হইয়া বসিয়া আছেন। সম্মুখের কালস্রোেত জগতের বৃহৎ জীবনযাত্রার প্রতি ধাবিত, কবি সেই বৃহৎ জীবনের জন্য উৎসুক। মাঝি নৌকা তীরে ভিড়াইল। কবির দান, তাঁহার সাধারণ ফসল—একান্ত হইয়া যাহা তাঁহার গণ্ডিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। মাঝি তাহা তুলিয়া লইল। কিন্তু সাধকের স্থান আর হইল না। কবিতাটির প্রাণ এই করুণ রসের। কবির দুঃখ কীসের! এতদিন নদীকূল যাহা লইয়া তিনি ভুলিয়া ছিলেন তার সমস্তই সোনার তরীর মাঝি তুলিয়া লইয়া গেল। এই প্রিয়বস্তু বিচ্ছেদের দুঃখ কবির।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment