নানাজনে ‘সোনার তরী’ কবিতাটির নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তোমার ব্যাখ্যাটি যুক্তি ও উদ্ধৃতিসহ উপস্থাপিত করো।
‘সোনার তরী’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পরে এর সপক্ষে ও বিপক্ষে নানা আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়। কবি নিজেও এই বিতর্কে যোগ দিতে বাধ্য হন। বিরূপ সমালোচনা যাঁরা শুরু করেন তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কবিতাটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলা হয়। প্রথমে একে বলা হয় দুর্বোধ্য রচনা।
দ্বিতীয়ত, রচনাটির মধ্যে নানা বর্ণনাগত অসঙ্গতি দেখানো হয়। যেমন, শ্রাবণ মাসে কোথাও ধান পাকে না, ধান কাটাও হয় না। চারিদিকে বাঁকা জলে ঘেরা দ্বীপের মত চর জমিতে ধানের চাষও হয় না। ভরা পালেই যদি নৌকা চলে, তবে আর তরী বাওয়ার কথা আসে কিভাবে? গ্রাম যদি মেঘে ঢাকাই হয়, তবে ‘মসীমাখা তরুচ্ছায়া দেখা যাবে কেমন করে? বিরুদ্ধ সমালোচকরা কবিতাটির শেষ স্তবকটিকে সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে মত প্রকাশ করেন। কবির পক্ষসমর্থনকারীরাও অভিযোগগুলোর জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন। কেউ বলেছেন, ‘সোনামুখী’ নামে একরকমের ধান বর্ষাকালেই কাটা হয়। ‘তরুচ্ছায়া’ শব্দের ব্যাখ্যা করে অন্য আর একজন বলেছেন, ‘তরুছায়া’ অর্থে তরুর ‘ছায়া’ নয়— তরুশ্রেণীর দৃশ্যমান রূপ বুঝতে হবে। ‘ছায়া’ অর্থে শুধুই ‘প্রতিবিম্ব’ বা ‘অনাতপ’ নয় ‘কান্তি’ও বোঝায়।
কবিতার শেষ অংশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবীন্দ্রসমর্থকরা এমনকি গীতার ভাষ্য পর্যন্ত উদ্ধৃত করেছেন। এই বিতর্কের ফলে বোঝা যায়, কবিতাটির ব্যাখ্যা খুব সহজ নয় এবং রূপকের আবরণের নীচে কবির একটা ভাবাবস্থা নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। কবিতাটির প্রতিকূল সমালোচনার পেছনে একটি বড় কারণ এই যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার ভাব ও ভাষায় যে অভিনবত্ব সঞ্চার করে দিয়েছিলেন, তার মর্মগ্রহণের উপযুক্ত পাঠকের সংখ্যা যে সময় খুবই অল্প ছিল।
কবিতাটিতে যে রূপকের আবরণ আছে তা উন্মোচিত করে ভেতরের ভাবটার তত্ত্বগত ব্যাখ্যা বিভিন্ন সমালোচক এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করেছেন। তত্ত্বগত ব্যাখ্যা নিয়ে মতৈক্যের সম্ভাবনা বিশেষ নেই, কিন্তু কবিতাটির কাব্যমূল্য কেউ অস্বীকার করতে পারেননি।
কবিতাটি উপভোগ করতে হলে এর তাৎপর্যটা ব্যাখ্যার চেষ্টা না করে উপায় নেই। কবিতাটির রূপকবিন্যাস অসাধারণ। পদ্মাতীরের বর্ষাপ্লাবিত শস্যক্ষেত্রে ধানকাটা এবং সেই ধান নিরাপদে বহন করে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে যে উৎকণ্ঠা—নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরন্তন এই বাস্তব দৃশ্যটাই কবিতাটির ভাবপরিমণ্ডল রচনা করেছে। ঘনায়মান বর্ষা, মেঘের গর্জন, নদীতীরে নিঃসঙ্গ ও নিরাশ চাষীর নৌকার জন্য প্রতীক্ষা, নদীর ক্ষুরধার স্রোত, ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডের চারিদিকে জলের বেষ্টন, পরপারে তরুছায়ায় মেঘান্ধকারে অস্পষ্ট গ্রামের ছবি— এ সমস্ত মিলে চাষীরা পরিচিত জগতের ওপরে যেন এক যবনিকা টেনে দিয়েছে। হঠাৎ একটা তরীকে আসতে দেখা গেল এর নাবিক যেন চাষীর কাছে অর্ধপরিচিত, মুখ তার নিয়তির মত নির্বিকার। কেবল তার গানই চাষীর কানে এসে বাজছে। চাষীর সজ্জিত সমস্ত সোনার ধান তরীতে স্থান পেল কিন্তু সে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বেদনার্ত হৃদয়ে নদীতীরে পড়ে রইল।
“গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।”
কোন এক লৌকিক কৃষকের আশা-নৈরাশ্য আন্দোলিত হৃদয়ানুভূতির রূপকে কবি এইভাবে নিজেরই ভাবনা-বেদনার স্বরূপ প্রকাশ করে তুলেছেন। কবিতায় বর্ণিত চাষী কবি স্বয়ং এবং সোনার ধান তাঁর সৃষ্টির পুঁজি সোনার ধান যখন তরীতে সঞ্চিত হল, কবির সৃষ্ট কাব্য অমরতার অধিকারী হল তখন কবি তাঁর ব্যক্তিসত্তার জন্যই তরীতে একটু স্থান চাইলেন, কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হলেন।
“ঠাই নাই, ঠাই নাই–ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।”
কিন্তু যিনি প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি কে? কেউ বলেছেন তিনি মহাকাল, কেউ বলেছেন তিনি কবি জীবনের অধিষ্ঠাতা দেবতা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ কবিতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন তিনি সংসার অর্থাৎ জগৎ। কবি, শিল্পীমাত্রেই ব্যক্তিজীবন এবং সেই জীবন থেকে সৃষ্ট শিল্পবস্তুর মধ্যে একটা বিচ্ছেদ মেনে নিতে বাধ্য হন। এই অনিবার্য বিচ্ছেদের বেদনায় কবির ব্যক্তিসত্তা ভারাক্রান্ত, শূন্যতাবোধে আচ্ছন্ন হলেও শিল্পলোকের এই বিধি অনতিক্রম্য। রবীন্দ্রনাথকেও এই সত্য মেনে নিতে হয়েছে। কবিতার শেষ স্তবকে কবির ব্যক্তিসত্তার বেদনাই তীব্রভাবে বেজে উঠেছে। তবু সেই বেদনার মধ্যে সান্ত্বনা এই যে, তাঁর সৃষ্টি কাব্যসম্পদে কালের তরণীখানি পূর্ণ হয়ে গেছে এবং বিশ্বজনের উদ্দেশে নিজের সৃষ্টিগুলি নিবেদন করে তিনি চরিতার্থ।
অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর