সর্বজনীন শিক্ষার ধারণা
‘সর্বজনীন শিক্ষা কথাটির অর্থ হল— সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতার পরে গঠিত কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬ খ্রিঃ.) জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে এই বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ।
সর্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি বিভিন্ন কারণে যেমন— জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও মানসিকতার অভাব এবং সরকারি উদাসীনতা। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার যেটুকু উন্নতি ঘটেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অপচয় ও অনুন্নয়ন একটি বড়াে বাধা। প্রথম শ্রেণিতে যতজন শিক্ষার্থী ভরতি হয় তার ১০% পর্যন্ত শিক্ষার্থী চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় পরিমাণগত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুণগত মানটিও বজায় রাখা একান্ত প্রয়ােজন। প্রাথমিক শিক্ষার সর্বজনীনতার জন্য ৩টি স্তর অতিক্রম করতে হবে। (১) সর্বজনীন শিক্ষার সুযোগ (Universal Provision), (২) সর্বজনীন ভরতির সুযোগ, (৩) সর্বজনীন পাঠ শেষ করা (Universal retention)।
সর্বজনীন শিক্ষার শর্ত
(১) সর্বজনীন শিক্ষা বা সকলের জন্য শিক্ষা: সকলের জন্য শিক্ষা বলতে বোঝায় –
শিশুদের বাড়ি থেকে ১ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যালয় থাকবে। সেখানে তারা উপযুক্ত বই, শিক্ষা উপকরণ ও যযাগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা পাবে।
বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোন জাতিগত ও লিঙ্গগত বৈষম্য থাকবে না।
সবশেষে, যারা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তারা যাতে মাঝপথে পড়া ছেড়ে না দেয় তা লক্ষ রাখতে হবে, অর্থাৎ অপচয় ও অনুন্নয়ন রােধ করতে হবে। নির্দিষ্ট মান পর্যন্ত শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে হবে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে UNO (United Nations Organisation), Universal Declaration of Human Rights অনুযায়ী ঘোষণা করে সর্বজনীন শিক্ষার হল, এমন এক কর্মসূচি যেখানে প্রতিটি মানুষের শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত হয়। এর ফলে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছে। স্বাধীন ভারতের সংবিধানের ৪৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানের চাল হওয়ার ১০ বছরের মধ্যে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত (অষ্টম শ্রেণি) প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের জন্য সর্বজনীন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) সর্বজনীন ভর্তির সুযোগ : সর্বজনীন ভর্তির সুযোগ কথার অর্থ হল ৬ বছর বয়সের প্রত্যেক শিশু যেন প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পায়, অর্থাৎ প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়স ৬ বছর নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের সমস্যা হল— যে-কোনো বয়সের শিশুর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে আসে। সুতরাং চেষ্টা করতে হবে যাতে একই বয়সের শিশু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারে।
(৩) সর্বজনীন পাঠ শেষ করা : সর্বজনীন পাঠ শেষ করা কথার অর্থ হল- যারা প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে তারা সকলেই যেন নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ শেষ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশের সবথেকে বড় সমস্যা হল প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে অপচয় ও অনুন্নয়ন। দেখা যায়, যারা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে তাদের অধিকাংশই নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শেষ না করে মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেয়। বেশ কয়েক বছর পর তারা নিরক্ষরতার অন্ধকারেই ডুবে যায়। কারণ যতটুকু পড়েছিল সেগুলি সে পরে ভুলে যায়। এইভাবে অপচয়ের হার আমাদের দেশে খুব বেশি। আবার ফেল করার দরুন একই ক্লাসে থাকতে হবে এই ভয়েও অনেকসময় পড়া ছেড়ে দেয়। কারণ, সে তখন কমবয়সি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়তে, বন্ধুদের ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক হয় না। অপচয় ও অনুন্নয়ন এর দরুন প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান খুব খারাপ।
শিক্ষার সর্বজনীনতার জন্য উপরােক্ত তিনটি স্তর পূরণ করতে হবে এবং গুণগত মান বজায় রাখতে হবে।