সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা যায় কি? রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত ঐশ্বরিক মতবাদটি সমালােচনা-সহ আলােচনা করাে।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা যায় কি না

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ রাষ্ট্রের মতাে একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা যাবে কি না সে সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। জাতিপুঞ্জ রাষ্ট্র কি না সে-সম্পর্কে মতামত দিতে হলে দেখা দরকার রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে চারটি উপাদানের প্রয়ােজন, যেমন—জনসংখ্যা, নির্দিষ্ট ভূখন্ড, সরকার ও সার্বভৌমিকতা, এগুলি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আছে কি না।

[1] জনসংখ্যা: রাষ্ট্র গড়ে ওঠার জন্য জনসংখ্যা আবশ্যক। কারণ, জনসংখ্যা ছাড়া রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সেই অর্থে জনসংখ্যা নেই। কারণ, জনগণনার পরিসংখ্যানে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের জনসংখ্যার কোনাে উল্লেখ নেই। জাতিপুঞ্জের কর্মচারী হিসেবে যারা কাজ করেন তারাও অন্য দেশের নাগরিক।

[2] নির্দিষ্ট ভূখণ্ড: রাষ্ট্র গড়ে ওঠার দ্বিতীয় অপরিহার্য উপাদান হল নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কোনাে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নেই। পৃথিবীর মানচিত্রে জাতিপুঞ্জের অবস্থানের কোনাে উল্লেখ নেই। জাতিপুঞ্জের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য জাতিপুঞ্জের বিভিন্ন সংস্থার দফতরগুলি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত।

[3] সরকার: রাষ্ট্র গঠনের জন্য তৃতীয় উপাদান হল সরকার সরকার ছাড়া রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। কারণ রাষ্ট্রের কার্যাবলি সরকারের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। জাতিপুঞ্জের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি পরিচালকমণ্ডলী আছে। অনেকে জাতিপুঞ্জের এই পরিচালকমণ্ডলীকেই সরকার বলে অভিহিত করেন।

[4] সার্বভৌমিকতা: রাষ্ট্র গঠনের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌমিকতা ছাড়া কোনাে রাষ্ট্র কল্পনাই করা যায় না। সার্বভৌমিকতা বলতে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত, অপ্রতিহত ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাকে বােঝায়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ হল কতকগুলি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংগঠন। জাতিপুঞ্জ তার সদস্যরাষ্ট্রগুলিকে কোনাে নির্দেশ দিতে পারে না, কেবল অনুরােধ করে। সদস্যরাষ্ট্রপুলি সেই অনুরােধ মানতেও পারে, নাও মানতে পারে। সুতরাং, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সার্বভৌমিকতা নেই।

মূল্যায়ন: উপরের বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোনাে প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে চারটি উপাদান আবশ্যক তার মধ্যে জাতিপুঞ্জের একটি উপাদান, অর্থাৎ সরকার আছে, অন্য তিনটি উপাদান, যথা—জনসংখ্যা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সার্বভৌমিকতা নেই। সুতরাং, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ রাষ্ট্র নয়।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ঐশ্বরিক মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে যেসব কাল্পনিক মতবাদ চালু রয়েছে তার মধ্যে প্রাচীনতম হল ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ। সেন্ট অগাস্টাইন, সেন্ট পল, রবার্ট ফিলমার হলেন এই মতবাদের প্রচারক।

[1] মূল বক্তব্য: এই মতবাদের মূল বক্তব্য হল—

  • ঈশ্বর নিজে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
  • পৃথিবীতে ঈশ্বরের মনােনীত প্রতিনিধি হলেন রাজা। ঈশ্বরের সব ইচ্ছা-অনিচ্ছা রাজার মাধ্যমে কার্যকরী হয়।
  • রাজার আদেশ যা আইনরূপে পরিচিত তা আসলে ঈশ্বরের আদেশমাত্র। কাজেই রাজার আদেশ অমান্য করার অর্থ হল ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করা।
  • রাজা যেহেতু ঈশ্বরের নির্দেশ ছাড়া অন্য কারও নির্দেশে কাজ করেন না, তাই রাজা কোনােরকম অন্যায় করতে পারেন না।
  • রাজা তাঁর যাবতীয় কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন।রাজার কাজকর্মের জন্য জনগণ কোনােভাবেই কৈফিয়ত চাইতে পারেন না।
  • রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করার অর্থ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা।
  • রাজা যেমন ঈশ্বরের অধীন, প্রজারাও তেমনি রাজার অধীন।
  • সেন্ট পল-এর মতে, রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন হল ঈশ্বর কর্তৃক আরােপিত কর্তব্য।
  • রাজা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজপদে আসীন হনএই বিধানটিও ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট। এইভাবে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ রাজতন্ত্রকে ঈশ্বরসৃষ্ট একমাত্র সুশাসন হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

[2] চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: ইউরােপে মধ্যযুগে যােড়শ শতাব্দীতে ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ধর্মগুরু পােপ ও রাজার মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে প্রবল বিরােধিতার সূত্রপাত ঘটে। পোপ নিজেকে ঈশ্বরের এক এবং অদ্বিতীয় প্রতিনিধিরূপে পরিচয় দিয়ে জনগণের অখণ্ড আনুগত্য দাবি করেন। সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস রাষ্ট্রের পরিবর্তে চার্চকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে মনে করতেন। মধ্যযুগের শেষপর্বে প্রােটেস্টান্ট আন্দোলনের ফলে পােপের প্রাধান্য খর্ব হয়। মার্টিন লুথার, ক্যালভিন প্রমুখ প্রােটেস্টান্ট নেতৃবৃন্দ রাজাকে ঈশ্বরের একমাত্র প্রতিনিধিরূপে তুলে ধরে জোরালাে আন্দোলন করেন। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে রাজার অধীন রাষ্ট্রকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হিসেবে ঘােষণা করেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে ঈশ্বরের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হলেন রাজা| এইভাবে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ এক চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। ষােড়শ শতাব্দীর পরবর্তীকালের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের অবসানের পথ প্রশস্ত করে। এক্ষেত্রে যেসব ঘটনা ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটায়, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলন, ইউরােপের নবজাগরণ, সামাজিক চুক্তিবাদের প্রসার এবং সর্বোপরি ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব (১৬৮৮ খ্রি.)।

[3] সমালােচনা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের ব্যাখ্যাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালােচনা করা হয়—

  • অবাস্তব: সমালােচকদের মতে, ঐশ্বরিক শক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বাস্তবভিত্তিক যুক্তিগ্রাহ্য ধারণা এই মতবাদে উপেক্ষিত। রাষ্ট্রের মতাে একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান কীভাবে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হতে পারে, তার কোনাে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ দিতে পারেনি।
  • অনৈতিহাসিক: রাষ্ট্র ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট এবং রাষ্ট্রের কর্ণধার রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের এই মূল বক্তব্যের সমর্থন ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং, ঈশ্বরের ইচ্ছার ফলে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে, এরকম ধারণা পুরােপুরি অনৈতিহাসিক।
  • অযৌক্তিক: সমালােচকদের মতে, ঈশ্বর করুণাময়, মানুষের কল্যাণে তিনি সদাজাগ্রত, তাই তাঁর প্রতিনিধি রাজা সর্বদা প্রজাদের কল্যাণে নিয়ােজিত থাকবেন—এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বহু অত্যাচারী ও প্রজা-নিপীড়নকারী রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। এই ধরনের অত্যাচারী রাজার কাজকে ঈশ্বরের ইচ্ছার অভিব্যক্তি বলে ধরে নিলে পরম করুণাময় ঈশ্বরের ধারণা কালিমালিপ্ত হতে বাধ্য।
  • অসম্পূর্ণ: শুধুমাত্র রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেই এই মতবাদ প্রযােজ্য, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনাে ধরনের শাসনব্যবস্থার। উৎপত্তির প্রসঙ্গে এই মতবাদের আলােচনা গ্রহণযােগ্য নয়। তাই এই মতবাদ অসম্পূর্ণ।
  • অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী: রাজা যেহেতু ঈশ্বরের একমাত্র প্রতিনিধি তাই রাজার আদেশ সমস্ত সমালােচনার উধ্বে—এই ধরনের যুক্তি স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। তা ছাড়া, এই মতবাদে রাজাকে তার কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। তিনি আর কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। এই মতবাদ রাজাকে আইনের ঊর্ধ্বে রেখে অগণতান্ত্রিকতা ও স্বৈরাচারিতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
  • রক্ষণশীল: ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ একটি রক্ষণশীল মতবাদ। রাজা যদি অন্যায় আচরণ করেন, সেক্ষেত্রেও প্রজাদের কোনাে বিরােধিতার অধিকার এই মতবাদে স্বীকার করা হয়নি।
  • নাস্তিকদের আনুগত্যহীন: যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তারা রাষ্ট্রকে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখাতে পারে। কিন্তু যারা নাস্তিক বা ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী তারা ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠানস্বরূপ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখাবে না। ফলে জনগণের এক অংশ রাষ্ট্রের আনুগত্য না দেখালে, রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।

উপসংহার: ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের কঠোর সমালােচনা সত্ত্বেও তত্ত্বটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। অধ্যাপক গেটেলের মতে, স্বায়ত্তশাসনের জন্য মানুষ যখন আদৌ যােগ্য হয়ে ওঠেনি, তখন এই মতবাদ আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছিল (It taught men to obey when they were not yet ready to govern themselves)’। তা ছাড়া, রাষ্ট্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি ধর্মের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তা ঐশ্বরিক মতবাদে স্বীকৃত হয়েছে।

Political Science (H.S-11) all Questions/Answers here

Leave a Comment