সমাজ সংস্কার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কি ছিল?

বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার

উনিশ শতকের ভারতবর্ষে যে কয়েকটি মনীষী জন্মগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০-১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। ভারতীয় সমাজের কুসংস্কারের বেড়াজাল তাকে ব্যথিত করে। তিনি উপলব্ধি করেন যে সামাজিক কুসংস্কার গুলি দূর না হলে সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব নয়। কুসংস্কার দূর করে সমাজ সংস্কারে কাজে তিনি নিজের জীবন ও কর্মকে নিয়োজিত করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, “বিদ্যাসাগরের মনীষী প্রাচীন ঋষিদের মতে, কর্মদক্ষতা ইংরেজদের মতে এবং হৃদয়বত্তা বাঙালির জননীর মত।

১. কৌলিন্য প্রথার বিরোধিতা

তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত কৌলিন্য প্রথার ফলে কুল রক্ষার উদ্দেশ্যে বহু পিতা-মাতা তাদের বালিকা কন্যাকে খুব বয়স্ক, এমনকি বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দিতেন। এর ফলে ভবিষ্যতে হিন্দু নারীর জীবনের সীমাহীন দুর্দশা নেমে আসতো। কৌলিন্য প্রথা স্বীকার হয়ে নারীরা যে রূপ অসহায় ভাবে বেঁচে থাকত তা বিদ্যাসাগরকে ব্যথিত করে। তিনি এই কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। কৌলিন্য প্রথার সুযোগ নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণরা কিভাবে নারীদের সর্বনাশ করেছে তা তিনি হুগলি জেলা ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে প্রমাণ দেন।

২. বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের উদ্যোগ

কৌলিন্য প্রথার ফলে অল্প বয়সে বহু নারী বিধবা হতো এবং তাদের জীবনে সীমাহীন দুর্দশা নেমে আসতো। বিধবা নারীদের জীবনে করুণ দশা বিদ্যাসাগরকে খুব ব্যথিত করে। দ্বীনি হিন্দু শাস্ত্র বিশেষত ‘পড়াশোনার সংহিত’ থেকে উদ্ধৃত নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বিধবা বিবাহ স্বাস্থ্যসম্মত। তিনি বিধবা বিবাহের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাছাড়া-দরিদ্র বিধবাদের সহায়তার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ট গঠন করে।

৩. বিধবা বিবাহর আইন পাস

উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনের প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন। বিধবা বিবাহ প্রচলন হওয়া উচিত কিনা এ বিষয়ে তিনি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের দুটি পুস্তিকা রচনা করেন। এক বছরের মধ্যেই পুস্তিকা দুটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়। তার উদ্যোগে বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ৪ অক্টোবর ১ হাজার ব্যক্তি স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পত্রের সরকারের কাছে পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে প্রচেষ্টায় বড়লাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে জুলাই ১৪০ নম্বর রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহ আইন পাস করেন। বিধবা বিবাহ প্রথার প্রবর্তনে বিদ্যাসাগরের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি।

৪. বিধবা বিবাহর আয়োজন

বিধবা বিবাহের প্রথা আইনসদ্ধি হওয়ার পর বিদ্যাসাগর নিজের উদ্যোগে বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন। তার উদ্যোগের সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যা রত্ন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বরের বর্ধমান জেলায় পলাশ ডাঙ্গার ব্রাহ্মণ নন্দ মুখোপাধ্যায় ১০ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতি দেবীকে বিবাহ করেন। বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণ চন্দ্রের সঙ্গে অষ্টাদশী বিধবা ভবসুন্দরীর বিবাহ দেন। বিধবার সঙ্গে নিজেও পুত্রের বিবাহ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর তার ভাই শম্ভু চন্দ্র কে লিখেছেন, “নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।” বিদ্যাসাগর ১৮৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নিজের উদ্যোগে ৮২ টাকা ব্যয় করে ৬০ জন বিধবার বিবাহ দেন।

৫. বাল্যবিবাহের বিরোধিতা

উনবিংশ শতকে ভারতের হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ প্রকোপ ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো ব্যবহার ফলে অল্প বয়সী মেয়েরা বিধবা হতো এবং বাকি জীবন চরম দুঃখ দুর্দশা কাটাতে বাধ্য হত। বাল্য বিবাহের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর সর্ব শুভকারী সভার মুখপাত্র ‘সর্বশুভকারী পত্রিকা’ রং প্রথম সংখ্যা তে বাল্যবিবাহের দোষ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় লেখা হয়-ভালো বিধবাদের দুঃখ মোচনের জন্য এই বিধবা বিবাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জোরালো প্রচার ও সোচ্চার প্রতিবাদ শুরু করেন। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করে মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১০ বছর ধার্য করে দেয়।

৬. বহু বিবাহের বিরোধিতা

পূরবী শতকে ভারতের হিন্দুর সমাজে বহু বিবাহ প্রথার প্রচলন ছিল। বিদ্যাসাগর এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে তোলেন। তিনি বর্ধমানের মহারাজা সহায়তায় বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে ৫০০০০ ব্যক্তি স্বাক্ষর সংবলিত একটি প্রতিবাদ পত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। বহুবিবাহ বন্ধের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর সহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে আঠারোশ সাতান্ন খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পর সরকার হিন্দুদের সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে বহুবিবাহ বন্ধের বিষয়টি আরো বেশি দূর এগোয়নি। বিদ্যাসাগর পরবর্তীকালে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বহু বিবাহ অস্বাস্ত্রীয়। তার প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারের ফলে বহু বিবাহের প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পায়

উপসংহার

সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কর্মবীর বিদ্যাসাগর আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছে। তিনি বলেছেন বঙ্গীয় নবজাগরণের অন্যতম স্রষ্টা এবং নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন – “বিধাতা বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্গভূমিকে মানুষ করিয়ে ভার দিয়েছিলেন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment