আরাকান রাজসভার দুজন মুসলমান কবির প্রধান রচনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের ভূমিকা।
মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের একটি শাখা বস্তুত লােকসাহিত্য-রূপে পরিচিত হবার যােগ্যতা রাখে। এই লােকসাহিত্যের তিনটি ধারা- ‘কিসসা সাহিত্য’, ‘পল্লীগীতিকা’ ও ‘লােকসঙ্গীত’। ‘কিসসা সাহিত্য’ কথাটি যথােপযুক্তভাবে বাঙলা ভাষায় ব্যবহৃত না হওয়ায় কথাটি অনেকটা অপরিচিত। এর অতিশয় পরিচিত কিন্তু অবাঞ্ছিত প্রতিশব্দ ‘মুসলমানী সাহিত্য কথাটিই অধিকতর প্রচলিত। মুসলমান কবিরাই এই সাহিত্যের স্রষ্টা এবং পােষ্টা বলেই এর এবম্বিধ পরিচিতি। রূপকথা বা কিসসা জাতীয় কাহিনীই এর উপজীব্য। এই কাহিনীগুলিতে কখন কখন ঐতিহাসিক ঘটনার স্পর্শ থাকলেও এরা যে মূলতঃ আদিম কল্পনা থেকেই জাত, এ কথা সহজ সত্যরূপেই স্বীকৃত। এ জাতীয় সাহিত্যের অপর বৈশিষ্ট্য ও প্রায় সর্বক্ষেত্রেই এগুলি অনুবাদ অথবা অনুকরণ মাত্র। বাঙলা ভাষায় স্বাধীন মৌলিক কিসসা সাহিত্য রচনা-প্রচেষ্টা প্রায় দেখা যায় না বলেই মনে হয়।
মুসলমানী সাহিত্য বা কিসসা সাহিত্যের আলােচনা প্রসঙ্গে রােসাঙ্ রাজসভার উল্লেখ অপরিহার্য। এই অঞ্চলটি বর্তমান কালে ব্রহ্মদেশের আরাকানে অবস্থিত হলেও এক সময় এখানে বাঙালী শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভূত সমাদর লাভ করেছিল, তা ঐতিহাসিক সত্য। এক সময় এখানে ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধধর্মও যথেষ্ট প্রসারলাভ করেছিল আবার মুসলমানগণ বাঙলাদেশে প্রভাব বিস্তার করবার পূর্বেই এই অঞ্চলটি তাদের দ্বারা অধ্যুষিত হয়েছিল। ফলে রােসাঙ রাজসভা ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ ও ইসলামী সভ্যতার ত্রিবেণী-সঙ্গমে পরিণত হয়েছিল। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রােসাঙ্ রাজগণ অনেকেই মুসলিম উপাধিও গ্রহণ করতেন। বাঙলাদেশে মুসলমান-পাঠান সংঘর্ষকালে বহু সম্রান্ত মুসলমান পরিবার এখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই রােসা রাজসভার পৃষ্ঠপােষকতায় বেশ কিছু মুসলমান কবি এখানে এক বিশিষ্ট সাহিত্য সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন—’কিসসা সাহিত্য’ বা ‘মুসলমানী সাহিত্য’ নামে এই সাহিত্যধারা লােকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত মানবিক ভাবযুক্ত ‘রােমান্স সাহিত্য’।
এই সাহিত্যধারার স্রষ্টা মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণ স্বাধীন রচনায় উদ্বুদ্ধ না হয়ে অনুবাদের সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন। এই অনুবাদ কোথাও মূলানুগ, কোথাও বা ভাবানুগ। গ্রন্থকারগণ প্রধানতঃ ফার্সী সাহিত্যের দ্বারস্থ হলেও কখন কখন তারা হিন্দী সাহিত্য থেকেও তাদের উপজীব্য আহরণ করেছেন। কাজেই লােকসাহিত্যের এই ধারাটি যে একান্তভাবেই অভারতীয় প্রেরণায় জাত, এমন কথা বলা চলে না। সুকুমার সেন মনে করেন যে এই ধারার সাহিত্যস্রষ্টা মুসলমান কবিরা ফারসী সাহিত্যের মধুকর এবং ভারতীয় সাহিত্যের রসসন্ধানী ছিলেন। এই মুসলমান কবিদের অনেকেই সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে যেমন ব্যুৎপন্ন ছিলেন, তেমনি ভারতীয় পুরাণাদির সঙ্গেও ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। তাই এই মুসলমানী সাহিত্যে ও সংস্কৃত সাহিত্যেও হিন্দু পুরাণের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। চৈতন্যোত্তর যুগে সাহিত্যে চৈতন্যপ্রভাবও অস্পষ্ট নয়। বস্তুতঃ নামে ‘মুসলমানী সাহিত্য’ হলেও বিভিন্ন ধর্মীয় ভাবের সমন্বয় প্রচেষ্টা এদের মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে। বিশেষত রােসাঙ বা আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপােষকতায় মুসলমানী সাহিত্যেই সুস্পষ্টভাবে মধ্যযুগীয় দেব-নির্ভরতার আখ্যানের পরিবর্তে সম্পূর্ণ লৌকিক প্রেমকাহিনীর সূচনা ঘটে।
বস্তুতঃ সপ্তদশ শতাব্দীতে বাঙলা ভাষায় সাহিত্যের যে সকল ধারা রচিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে আরাকানের রােসা রাজসভায় বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিকগণ যে সাহিত্যধারা সৃষ্টি করেছিলেন, বৈচিত্র্যে এবং উৎকর্ষে এগুলিই সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এঁদের রচিত কাব্যের বিষয়বস্তু প্রধানতঃ অভারতীয় এবং ক্বচিৎ ভারতীয় হলেও নিঃসন্দেহে অবঙ্গীয়। আরও বিস্ময়ের বিষয় এই যে, এ-জাতীয় সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতাও এসেছে এমন এক রাজ্য থেকে যেখানে জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বাঙালী ও বাংলার কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকবার কথা নয়। তবে কবিরা ছিলেন নিঃসন্দেহেই বাঙালী এবং বাংলা-ভাষাভাষী। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য কবি দুইজনই—দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল। দৌলত কাজী রচিত গ্রন্থে ‘সতী ময়নামতী’ বা ‘লাের চন্দ্রানী’ (অসম্পূর্ণ) এবং সৈয়দ আলাওল-রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে হয়েছে—‘পদ্মাবতী’, ‘সয়ফলমূলক বদিউজ্জমাল’, হপ্তপয়কর’, ‘তােহফা’, ‘সেকেন্দারনামা’, ‘সতী ময়নামতী’ (সম্পূর্ণতা সাধন) প্রভৃতি।
(ক) দৌলত কাজী
রােসাঙ-রাজ থিরি থু-ধন্মা বা রাজা শ্রীসুধর্মার লস্কর উজীর পণ্ডিতপ্রধান আশারফ খান ঠোট-হিন্দিতে সাধন-রচিত মৈনা-সৎ’ বা সতী ময়নার কাহিনী শুনে কবি দৌলত কাজীকে দেশী ভাষায় তা’ রচনা করতে অনুরােধ করেন—কবি দৌলত কাজী আত্মপরিচয় দান প্রসঙ্গে এই তথ্যটি জ্ঞাপন করেছেন। শ্ৰীসুধর্মার রাজত্বকাল ১৬২২-৩৮ খ্রীঃ, অতএব এই কালেই কবি তার সতী ময়নামতী বা লাের চন্দ্রানী কাব্যটি রচনা করেছিলেন বলে অনুমান করা চলে।
‘লাের চন্দ্রানী’ নামে বিখ্যাত সতী ময়নামতীর কাব্যকাহিনীর প্রথম খণ্ড সম্পূর্ণ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের বারমাস্যার এগারাে মাস পর্যন্ত রচনা করবার পর দৌলত কাজী দেহত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থটি সমাপ্ত করেন কবি আলাওল। আলাওল উল্লেখ করেছেন—
বৈশাখ সমাপ্ত জ্যৈষ্ঠ অসাঙ্গ রহিলা।
তবে কাজী দৌলত স্বর্গেতে হইল লীন।
লাের চন্দ্রানীর কাহিনী অনেকটা রূপকথাধর্মী। লাের রাজার ‘ময়না’ নামে সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি গােহারীর রাজকন্যা এবং বামনবীরের পত্নী চন্দ্রানীর প্রতি আকৃষ্ট হন। বামনবীর রাজার হস্তে মৃত্যুবরণ করেন। গােহারীর রাজা সংবাদ পেয়ে লাের রাজাকে সমাদরে রাজ্যে নিয়ে আসেন এবং তার হাতে কন্যা চন্দ্রানীকে সমর্পণ করেন। এখানেই প্রথম খণ্ড সমাপ্ত। দ্বিতীয় খণ্ডে সতী ময়নামতীর বিরহ। এক রাজার পুত্র ছাতন ময়নাকে হস্তগত করতে চাইলে সতী ময়না তা প্রত্যাখ্যান করেন। তৃতীয় খণ্ডে-কীভাবে সতী ময়না এক ব্রাহ্মণের সহায়তায় আবার লাের রাজার মনে পূর্বস্মৃতি ফিরিয়ে এনে তাকে ফিরে পেলেন, সেই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে দৌলত কাজীর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযােগ্য। তিনি যেমন একদিকে লৌকিক সাহিত্যধারার প্রথম কবি, তেমনি আবার মুসলমান কবিদের মধ্যেও তিনি প্রাচীনতম এবং শ্রেষ্ঠ। কবির পৃষ্ঠপােষক উজীর আসরফ খান ছিলেন ‘চিন্তি খানদান’, কবি নিজেও সুফী সাধনার দিকে বিশেষ আকৃষ্ট ছিলেন। সম্ভবত সূফীবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকায় তাঁর কাব্যে একটা অতিশয় উদার মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি কালিদাস, জয়দেব এবং বিদ্যাপতির রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। হিন্দুর বিভিন্ন পুরাণ এবং মহাকাব্য সাগ্রহে অধ্যয়ন করেছেন। তার গ্রন্থে এ সস্ত প্রসঙ্গও বইবার তিনি উল্লেখ করেছেন।
বস্তুতঃ তাঁর কাব্যে বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে কবিত্বশক্তি যুক্ত হওয়াতে তার ‘লাের চন্দ্রানী’ কাব্য বিশেষ উপভােগ্য হয়ে উঠেছে। ডঃ সুকুমার সেন দৌলত কাজীর কবিত্বপ্রতিভা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেছেন – “দৌলত কাজীর কবিত্ব বিশেষ উল্লেখযােগ্য। মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দাবী করিতে পারেন তাহাতে সন্দেহ নাই। কি বাঙালা কি ব্রজবুলি উভয়বিধ রচনাতেই সমান দক্ষতা দেখাইয়াছেন।”
দৌলত কাজী রচিত ‘লাের চন্দ্রানী গ্রন্থটি সাধারণভাবে অনুবাদ গ্রন্থ-রূপে পরিচিত হলেও কবি যে মৌলিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না, এমন কথা বলা চলে না। মিয়া সাধন রচিত যে মূল গ্রন্থ-অবলম্বনে দৌলত কাজী তার ‘লাের চন্দ্রানী’ রচনা করেন সেই মূল গ্রন্থের একটি ক্ষুদ্র পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছে। তা থেকে অনুমান করা চলে যে দৌলত কাজী উক্ত গ্রন্থের কোন অংশ আক্ষরিক অনুকরণ করলেও বহু স্থলেই কাহিনীমাত্র গ্রহণ করে আপন প্রতিভাবলে তার পূর্ণতা সাধন করেছেন। কাজেই দৌলত কাজী অনুবাদ রচনা করলেও তাঁর মৌলিক প্রতিভা যথাযােগ্য স্বীকৃতির দাবী রাখে। কাব্যের যে সমস্ত অংশ কবি স্বয়ং রচনা করেছেন, অর্থাৎ যে অংশটি অনুবাদ নয়, তার বিচার বিশ্লেষণে কবির কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। কবি আলাওল দৌলত কাজীর অসম্পূর্ণ গ্রন্থকে সম্পূর্ণতা দান করেন এবং স্বয়ং বহু গ্রন্থ রচনা করে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উল্লেখযােগ্য স্থান অধিকার করে আছেন। তুলনামূলক বিচারে কিন্তু আলাওল-রচিত অংশ অপেক্ষা দৌলত কাজী রচিত অংশের উৎকর্ষ পরিলক্ষিত হয়।
সুধী সমালােচক ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় আলাওলের তুলনায় দৌলত কাজীর রচনার উৎকর্ষ এবং কবির বৈশিষ্ট্য-বিষয়ে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানিয়ে মন্তব্য করেছেন ঃ “আলাওল যেটুকু সমাপ্ত করেন তার কাব্যমূল্য অকিঞ্চিৎকর, গল্পের বাঁধুনি শিথিল, অনাবশ্যক অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারে ভারাক্রান্ত। আলাওল কাব্যটি সমাপ্ত করেছেন বটে, কিন্তু দৌলত কাজীর কবিত্ব ও মেজাজের ধারা অনুসরণ করতে পারেন নি। ….আলাওল অধিকতর বিখ্যাত ও বিচিত্র প্রতিভাধর কবি হলেও প্রকৃত কবিত্বে দৌলত কাজী অধিকতর শ্রেষ্ঠ তাতে সন্দেহ নেই। এর পরিচ্ছন্ন ভাষা, নিপুণ ছন্দ-জ্ঞান, সংস্কৃত সাহিত্যপুরাণে অবাধ বিচরণ, জীবনের অভিজ্ঞতা অতি উৎকৃষ্ট। ‘লাের চন্দ্রানী’ বা ‘সতী ময়না’ কাব্য মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভঙ্গ করে এক অভিনব আদর্শের পথ খুলে দিয়েছে কিন্তু হিন্দু কবিরা এর দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ মুসলমান কবিদের কাব্য বিশেষত যাতে দেবদেবীর কথার চেয়ে মানুষের কথা থাকত বেশী সে যুগে হিন্দুসমাজে তার বিশেষ প্রভাব ছিল না। তাই এই উৎকৃষ্ট কাব্যখানি সে যুগে ততটা প্রচারিত হয় নি। কিন্তু আধুনিক কালের রসিক পাঠক কবি দৌলত কাজীকে যথার্থ কবিপ্রতিভার অধিকারী বলে শ্রদ্ধা করবেন।”
(খ) আলাওল:
প্রাগাধুনিক যুগের মুসলমান কবিদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত কবি আলাওল অনেকের মতে শ্রেষ্ঠ কবিও বটেন। আলাওল-ও দৌলত কাজীর মতােই রােসাঙ রাজসভাকে অলঙ্কৃত করেছিলেন। তিনি তার কোন কোন কাব্যে আত্মপরিচয় দান করেছেন, তাতে তার জীবনের বিচিত্র এবং ঘটনাবহুল কাহিনী বিস্তৃতভাবেই পরিবেশিত হয়েছে।
সম্ভবত বর্তমান ফরিদপুর বরিশাল অথবা চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ পরগণার জালালপুর গ্রামে কবি আঃ ১৬০৮ খ্রীঃ (অথবা ১৫৯২ খ্রীঃ) জন্মগ্রহণ করেন। আলাওল পিতার সঙ্গে ভ্রমণকালে একবার জলদস্যুদের হাতে পড়েন এবং তখন পিতার মৃত্যু ঘটে। আলাওল রােসাঙে উপনীত হয়ে অশ্বারােহী সৈন্যদলে ভর্তি হন। সত্বরই স্বীয় পাণ্ডিত্যের খ্যাতিতে তিনি রােসাঙরাজ থদো মিস্তোর (রাজত্বকাল ১৬৪৫-১৬৫২ খ্রীঃ) মুখ্য অমাত্য মাগন ঠাকুরের বন্ধুত্ব লাভ করেন এবং তাঁর সহায়তায় রােসাঙ্ রাজসভায়ও আশ্রয়প্রাপ্ত হন। ১৬৬১ খ্রীঃ বাদশা শাহজাহানের পুত্র সাহ সুজা রােসাঙ রাজসভায় আশ্রয়লাভ করলে তাঁর সঙ্গে আলাওলের সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়। শাহসুজা রাজকোপে পতিত হলে আলাওলকেও কিছুদিন কারাগার জীবন-যাপন করতে হয়েছিল। বন্দীজীবন থেকে মুক্তিলাভের পরও আলাওলকে কিছুদিন নানাপ্রকার দুর্ভোগে পড়ে বিড়ম্বিত হতে হয়েছিল।
অবশেষে কবি রােসাঙের কাজী সৈয়দ মুসার অনুগ্রহ লাভ করেন এবং কাদেরী মতে দীক্ষিত হন। কবি আলাওল রােসাঙ্রাজ শ্রীচন্দ্র সুধর্মার রাজসভাতে বর্তমান ছিলেন। তিনি ১৬৭৩ খ্রীঃ পরলােকগমন করেন।
সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে কবি আলাওলের মতাে ভুরি-স্রষ্টা কবি মাত্র একজনই ছিলেন, তিনি কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী। এছাড়া অপর কোন কবিই আলাওলের মতাে এত অধিক গ্রন্থ রচনা করে উঠতে পারেন নি। আলাওল-রচিত প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মাবতী’ তার পৃষ্ঠপােষক মাগন ঠাকুরের অনুরােধে রচিত হয় সম্ভবতঃ ১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দে। কবির দ্বিতীয় কাব্য ‘সয়ফুল মলুক বদিউজ্জমাল’ রচনা করেন সম্ভবতঃ ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই। গ্রন্থটি দীর্ঘদিন অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে সৈয়দ মুসার নির্দেশে গ্রন্থটি সমাপ্ত করেন সম্ভবতঃ ১৬৭২ খ্রীষ্টাব্দের পর। দৌলত কাজী তার একমাত্র কাব্য ‘লােরচন্দ্রানী’ বা ‘সতী ময়না’ অসমাপ্ত রেখে পরলােকগমন করলে আলাওল সম্ভবতঃ ১৬৫৯ খ্রীঃ গ্রন্থটি সমাপ্ত করেন। শ্রীচন্দ্র সুধর্মার সেনাপতি সৈয়দ মুহম্মদের আদেশে আলাওল ১৬৬০ শ্রীঃ বা কাছাকাছি সময় রূপকথা জাতীয় গ্রন্থ ‘সপ্ত পয়কর’ বা ‘হপ্ত পয়কর’ রচনা করেন। আলাওলের অপর একটি গ্রন্থ ‘তয়ফা’ বা ‘তােহফা’ ১৬৬৩-৬৪ খ্রীঃ সমাপ্ত হয়েছিল বলে কবি উল্লেখ করে গেছেন। শ্রীচন্দ্র সুধমার প্রধান অমাত্য মজলিস নবরাজের আদেশে কবি সম্ভবতঃ মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সেকেন্দারনামা’ রচনা সমাপ্ত করেন।
এগুলি ছাড়াও আলাওল ‘যুসুফ- জোলায়খা, লায়লা-মজনু, শিরিখােসরােনামা’ এবং ‘আজিজকুমার রসবতী’ নামক কয়েকটি কাব্যও রচনা করেছেন বলে অনুমান করা হয়—কিন্তু এই অনুমানের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই আশঙ্কা করা হয়। তবে আলাওল যে রাধাকৃষ্ণ-লীলা-বিষয়ক কয়েকটি পদ এবং ‘রাগনামা’ নামে একটি সঙ্গীত-বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, এ বিষয়ে বিশেষ মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না।
এত সমস্ত গ্রন্থ রচনা করা সত্ত্বেও যে কবি আলাওল সামগ্রিকভাবে বাঙলা সাহিত্যে খুব একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন নি এবং তার জনপ্রিয়তা যে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, তার একমাত্র কারণ—তার রচিত অধিকাংশ গ্রন্থই ইসলামী কাহিনী ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক। এই গ্রন্থগুলি তিনি আরবী বা ফার্সী থেকে ভাষান্তরিত করেছেন মাত্রএতে তিনি কোন মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেন নি। আরব্য উপন্যাসের ‘আলফা লায়লা’ কাহিনী অথবা কোন ফার্সী কাহিনী-অবলম্বনে কবি আলাওল নায়ক সয়ফুল মূলুক এবং নায়িকা বদিউজ্জমাল-এর রােমান্টিক প্রেমকাহিনী রচনা করেন। ইরানী কবি নেজামী সমরখন্দের ফার্সী ভাষায় রচিত আরব রাজকুমার বাহরামের যুদ্ধ জয় এবং তাঁর সাতজন পত্নীর কাহিনী অবলম্বনে আলাওল ‘সপ্ত পয়কর’ গ্রন্থ রচনা করেন। এটিও অনুবাদ গ্রন্থ। শেখ য়ুসুফ-রচিত ‘তুহফাতুন্নসা’ নামক ফারসী নীতিবাক্য অবলম্বনে আলাওল ‘তােহফা’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। নীতি-উপদেশ সম্বলিত এই গ্রন্থটি কাব্যের মর্যাদাই লাভ করতে পারে না। ফারসী কবি নেজামী সমরকন্দীর ‘ইসকান্দারনামা’ নামক আলেকজাগুডারের দিগবিজয় কাহিনীর রূপকথা-জাতীয় গ্রন্থের সরল অনুবাদ আলাওলের ‘সেকেন্দারনামা’—তবে এই গ্রন্থে কবি তার পঞ্চ ভাষাজ্ঞানের উল্লেখ করে বলেছেন—
আরবী ফারসী পােস্তু নছরাণী ইহুদী।
পবি সঙ্গে পঞ্চ ভাষ রত্নাবধি।
দৌলত কাজী রচিত লাের চন্দ্রানী’ গ্রন্থ তিনি সমাপ্ত করলেও দৌলত কাজীর মান বজায় রাখতে পারেন নি। কবিত্বের দিক থেকে দৌলত কাজী অধিকতর প্রশংসনীয় কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেনবস্তুতপক্ষে কবি আলাওলের যত খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা তা প্রধানতঃ তার পদ্মাবতীকে অবলম্বন করেই।
‘পদ্মাবতী’কে কেউ কেউ বাঙলা সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক রােমান্সের মর্যাদা দান করে থাকেন। কিন্তু পদ্মাবতী কোন মৌলিক কাব্যগ্রন্থ নয়। মালিক মহম্মদ জায়সী হিন্দী ভাষায় পদুমাবৎ নামে যে কাব্য রচনা করেন, কবি আলাওল তাকেই বাঙলা ভাষায় অনুবাদ করেন। তবে আলাওলের পদ্মাবতীকে নিছক অনুবাদও বলা চলে না, কারণ উভয়ের মধ্যে কাহিনীগত মােটামুটি ঐক্য থাকলেও কবি বহস্থলেই স্বাধীনচিত্ততারও যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে দু’টি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা চলে। মুহম্মদ জায়সী তার পদুমাবৎ’ কাব্যকে রূপক রূপে বর্ণনা করেছেন। কাব্যোক্ত চিতােররাজ্যকে তিনি মনরূপে,রাজা রত্নসেনকে জীবাত্মারূপে, রাণী পদ্মাবতীকে বিবেকরূপে এবং শুকপক্ষীকে ধর্মগুরুরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। আলাওলের কাব্যটিকে একান্তভাবে প্রেমকাব্যরূপেই গ্রহণ করা চলে। আরও একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য পদ্মাবতীকে কিছুটা নিজস্বতায় মণ্ডিত করেছে। মূল পদুমাবৎ কাব্যে মুসলমান সম্রাট আলাউদ্দিনের জয় প্রদর্শন করা হয়েছে, কিন্তু আলাওলের পদ্মাবতীতে আলাউদ্দিনের পরাজয় ঘােষিত হয়েছে। কবির এই কাহিনী পরিবর্তন থেকে তার উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য বলেন- “কবির যুগজয়ী বিশ্বমানবতাই এই ইতিহাস-বিরােধিতার প্রকৃত কারণ। আলাওল ছিলেন সৌন্দর্যগত-প্রাণ সত্যকার কবি। তাহার ধারণা ছিল—বিশ্বজগতে, অন্ততঃপক্ষে কাব্যজগতে ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়ই চিরন্তন সত্য। কোনরূপ সঙ্কীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বজাতিপ্রীতি তাহার এ-বিশ্বাস টলাইতে পারে নাই।” এ ছাড়া মূল গ্রন্থ থেকে এই অনুবাদ গ্রন্থ আরাে একদিক থেকে অনেকখানি পৃথক। মূল কাহিনীটি বিয়ােগাস্তক হালেও আলাওল এটিকে মিলনাস্তক কাহিনীতে রূপান্তরিত করেছেন।
রস-বিচারেও পদ্মাবতীর কিছুটা বৈশিষ্ট্য স্বীকার করতে হয়। কবি আলাওল ছিলেন কাদেরী সম্প্রদায়ভুক্ত, তাই তার মধ্যে ছিল যথেষ্ট পরিমাণে ধর্মীয় উদারতা। আলাওল-রচিত বৈষ্ণব পদাবলী থেকেই এর সমর্থন পাওয়া যায়। এই বৈষ্ণবতাবােধ ‘পদ্মাবতী’তেও যে সংক্রামিত হয়েছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। সালােচকদের কেউ কেউ ‘পদ্মাবতী’কে বৈষব কাব্যের রসে সিক্ত বলেই অনুভব করেন। আলাওল বৈষ্ণব পদের সাদৃশ্যযুক্ত অনেকগুলি পদও তার গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেছেন। সুফী সাধক আলাওল-এর সঙ্গে বাঙালী বৈষ্ণব কবিদের একটা ভাবগত ঐক্য ছিল বলেই পদ্মাবতী কাব্যে কবির বৈষ্ণব সম-প্রাণতার পরিচয় পাওয়া যায়।
পদ্মাবতীতে কাহিনী রয়েছে দুটি অংশে। প্রথম অংশে চিতাের রাজ রত্নসেনের সঙ্গে সিংহল রাজকন্যা পদ্মাবতীর বিবাহ এবং চিতাের-প্রত্যাবর্তন-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কাহিনীর দ্বিতীয় অংশে পাঠান-সম্রাট আলাউদ্দিন কর্তৃক পদ্মাবতীকে অধিগত করবার আকাঙ্ক্ষায় চিতাের আক্রমণ, যুদ্ধে আলাউদ্দিনের পরাজয় কিন্তু রত্নসেনের মৃত্যু এবং পদ্মাবতীর সহমরণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
কাহিনীটির দ্বিতীয় অংশের জটিলতা বেশি থাকায় এখানে নাটকীয়তা প্রকাশের সুযােগও বেশি ছিল, কিন্তু কবির আকর্ষণ ছিল কাহিনীর প্রথমাংশের প্রতি কারণ এর প্রেমকাহিনীটিই কবির প্রতিভা বিকাশের উপযােগী ক্ষেত্র বলে বিবেচিত হয়েছিল। এই সরল সহজ প্রেমকাহিনী বর্ণনায় কবি আলাওলের কবিত্বশক্তি যেমন সচ্ছল ও সাবলীল গতিতে অগ্রসর হয়েছে, পরবর্তী জটিল, নাটকীয় ঐতিহাসিক কাহিনী বর্ণনায় কবিচিত্ত তেমন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠতে পারেনি। আলাওল মুলতঃ কবি ছিলেন বলেই পদ্মাবতীতে যে স্ব-ধর্মের জয় ঘােষণা করেননি, তেমনি ঐতিহাসিক নিষ্ঠার প্রতিও বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেননি। প্রেমকে প্রধান উপজীব্য করে তিনি খাটি কাব্য রচনা করতে চেষ্টা করেছেন এবং তা থেকেই আমরা অনুভব করতে পেরেছি, কবির হৃদয়ানুভূতির ক্ষেত্র ছিল কত গভীর, কত প্রসারিত। এই গুণেই মূল ‘পদুমাবৎ’ কাব্য অপেক্ষা আলাওলের পদ্মাবতী’ অনেকাংশ উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়।
জনৈক সুধী সমালােচক আলাওলের পদ্মাবরতী কাব্যকে তার যথােপযুক্ত মর্যাদা দান করে মন্তব্য করেছেন, “বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে সম্ভবতঃ ইহাই প্রথম সত্যকার ব্যক্তিসাহিত্য। এই কাব্যের সূচনায় যেমন কবির ব্যক্তিজীবনকে, তেমনি কাব্যের মধ্যে কবি-মানুষকে সুস্পষ্টরূপে দেখিতে পাওয়া যায়।…ইহাতে ইতিহাসাংশ থাকিলেও ইহা যথার্থ কাব্য এবং রঘুবংশ,কাদম্বরী প্রভৃতি ক্লাসিক্যাল কাব্যের সমশ্রেণীতে স্থান পাইবার যােগ্য। সপ্তদশ শতকে রচিত হইলেও ইহা উদার ও সর্বজনীন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চিহ্নমাত্র ইহাতে নাই।”