সংস্কার আন্দোলনে প্রার্থনা সমাজের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো?

সংস্কার আন্দোলনের প্রার্থনা সমাজের অবদান

ভারতে উপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ঢেউ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ও ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলার বাইরে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে যে সকল প্রতিষ্ঠানের অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল প্রার্থনা সমাজ। কেশব চন্দ্র সেন এর সংস্কার আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মহারাষ্ট্রে সমাজ সংস্কার আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ ১৮২৩-১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রে প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে বিচার প্রতি মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ১৮৪২-১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ও ঐতিহাসিক রামকৃষ্ণ ভান্ডারকর ১৮৩৭-১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে পার্থনা সমাজে যোগদান করলে এদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটি সমাজ সংস্কার আন্দোলন খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইংরেজি শিক্ষিত চিতপাভন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়, গুজরাট ও ফরাসি বণিক প্রমুখ এই সমাজের একনিষ্ঠ সমর্থককে পরিণত হয়।

১. আদর্শ

প্রার্থনা সমাজ হিন্দু ধর্ম বা সমাজ বিরোধী ছিল না। তবে যারা ছিলেন বেদের অপৌরূষেয়তা, জন্মন্তরবআদ, অবতারবাদ ও পৌত্তলিকতা বিরোধী এবং একেশ্বর বাদের সমর্থক। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ এবং মহারাষ্ট্রের তুকারাম, জ্ঞানেশ্বর প্রমুখ ভক্তিবাদী ধর্ম গুরুদের আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রার্থনা সমাজ তার সংস্কার কর্মসূচীর আদর্শ তৈরি করে।

২. নারী কল্যাণ

পার্সোনাল সমাজে প্রাণপুরুষ মহাদেব গোবিন্দ রানাডে বলেন যে, “আমরা আমাদের অতীত এবং আমাদের সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় না।” তিনি বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ সমিতি প্রতিষ্ঠান করে। বিধবা বিবাহের সার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সারদা সনদকে তিনি স্বাগত জানান। স্ত্রী শিক্ষা প্রসার, নারী মুক্তির আদর্শ প্রচার, বিধবা আশ্রম প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয়ক তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

৩. শিক্ষা প্রসার

প্রার্থনা সমাজে আদর্শকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। এই সমাজে প্রাণপুরুষ মহাদেব গোবিন্দ রানাডে দক্ষিণাত্য শিক্ষা সমাজ বা ডেকনা এডুকেশন সোসাইটি ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার উদ্যোগে কোন ধরনের সরকারি সহায়তা ছাড়াই পুনরা ‘ফারগুসন কলেজ’ এবং পাংশার ‘উইলিংডন কলেজ’প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও প্রার্থনা সমাজে বেশ কয়েকটি গ্রন্থাগার ও নৈশ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করে।

৪. সমাজ সংস্কার

প্রার্থনা সমাজকর্ম অপেক্ষা সমাজ সংস্কার কে বেশি গুরুত্ব দেয়। রানাডে তার গ্রন্থে লিখেছেন যে, ঐতিহ্য এবং বাস্তবকে অস্বীকার করে যুক্তি রাষ্ট্রের সংস্কারমূলক কাজ অর্থহীন। প্রার্থনা সমাজ অস্পষ্টতা, জাতিভেদ প্রার্থনা, পর্দা প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মদ্যপান প্রভৃতির বিরোধিতা করে এবং অসবর্ণবিবাহ কি সমর্থন করে। সামাজিক উন্নয়ন, সমাজের দুঃস্থাদের কল্যাণ, শিশুর সনদ, অনাথ আশ্রম, চিকিৎসালয় স্থাপন প্রবিতি বিষয়ে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার বিষয় আলোচনা চালানোর উদ্দেশ্যে তার উদ্যোগে মাদ্রাজে ভারতীয় জাতীয় সমাজ সম্মেলনে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে আহ্বান করেন।

৫. ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি

প্রার্থনা সমাজ ধর্ম সমন্বয়ের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। এর সদস্যরা বিশ্বাস করতেন যে, সকল ধর্মের মধ্যেই সত্য লুকিয়ে আছে। তার প্রতি রবিবার সপ্তাহিক সমাবেশে আয়োজন করত। এই সমাবেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্র পাঠ করা হতো। তারা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে মতপার্থক্যের বিষয়টি যথাসম্ভব এগিয়ে চলতেন। তবে তারা হিন্দু ধর্মের প্রচলিত কুসংস্কার গুলি তীব্র সমালোচনা করে এবং ধর্মীয় বিষয়ে কঠোর নীতি গ্রহণ কে সমর্থন করেন।

৬. সর্বজনীক সভা

ভারতীয়দের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সমাজ উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সমাজের অন্যতম নেতা মহাদেব গোবিন্দ রানাডে পুনরায় সর্বজনীন সভা ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার

প্রার্থনা সমাজের উদ্যোগে শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটলে ও তা সমাজের সব শ্রেণীর জনগণের মধ্যে পৌঁছায়নি। বাংলার ব্রাহ্মসমাজের মতো শাখা প্রশাখা বিস্তারে প্রার্থনা সমাজ সক্ষম হয়নি। তবে ভারত ব্রিটিশ শাসনকালে প্রার্থনা সমাজের সংস্কার কর্মসূচি ক্রমশ পিছিয়ে পড়া ভারতীয় সমাজকে আলো দিশা দেখায়। মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ ও অন্ধের তেলেগু ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রার্থনা সমাজ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে প্রার্থনা সমাজের আন্দোলন কে খুব সক্রিয় করে তোলেন। দীনবন্ধু এন্ড্রুজ এর মতে, সংস্কার হিসেবে তিনি রামমোহন স্যার সৈয়দ আহমদের প্রায় কাছাকাছি ছিলেন। রানাডে অনেক সমাজ সংস্কারকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিক্ষা ভর্তি ও বিধানকর্তা গোপালকৃষ্ণ গোখলে যিনি রানাদের মৃত্যুর পর তার সংস্কারমূলক কাজ গুলি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment