সংবিধান সভার গঠন
সূচনা
স্বাধীনতা লাভের বহু আগে থেকে ভারতবাসীর দাবি ছিল তারা গণপরিষদ বা সংবিধান সভা গঠন করে নিজেদের সংবিধান নিজেরাই রচনা করবে। সেইমতো স্বাধীনতা লাভের আগে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে গণপরিষদ গঠিত হয়।
গঠন পদ্ধতি
১. বিভিন্ন সম্মেলনের দাবি মেনে
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে গণপরিষদ গঠনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর তিন বছর পরে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের রামগড় কংগ্রেস ও সম্মেলনে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি গণপরিষদ গঠনের পক্ষে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করে। অবশেষে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে ভারতের সংবিধান রচনার বিষয়টি নীতিগতভাবে মেনে নেয়।
২. কুপল্যান্ড পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন চার্চিল মন্ত্রিসভা সদস্য স্ট্যার্ফোড ক্রিপস ভারতে আসেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ ২৩ মার্চ। ক্রিপস ভারতবর্ষের কাজে তার বিভিন্ন প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে বলা হয় ব্রিটিশ সরকার ও গণপরিষদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেস ও ক্রিপস প্রস্তাবকে আগ্রহ করে। ব্রিটিশ কূপল্যান্ডকে ভারতে পাঠায়। কূপল্যান্ড ঐকমত্যের ভিত্তিতে কংগ্রেস ও লীগের কাছে ক্ষুদ্র আকারের গণপরিষদ গঠনে প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাবের সংখ্যা গরিষ্ঠতার পরিবর্তে ঐকমতের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠনের উল্লেখ থাকায় কূপল্যান্ড পরিকল্পনা ও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
৩. মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব মেনে
মন্ত্রী মিশনে পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি মূল নীতির ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠিত হয়। এই চারটি নীতি ছিল –
(১) ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশে ও দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের মোট জনসংখ্যার নির্দিষ্ট অনুপাত অনুযায়ী গণ পরিষদে আসন লাভ করবে। প্রতিটি প্রদেশে ১০ লক্ষ জন পিছু একজন করে প্রতিনিধি গণপরিষদে পাঠাতে পারবে।
(২) গণপরিষদের সকল আসন সাধারণ শ্রেণী (অ-শিখ, অ-মুসলমান), শিখ ও মুসলমান এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে আনুপাতিক ঘাড়ে ভাগ করে দেয়া হবে।
(৩) প্রাদেশিক আইনসভা গুলিতে প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের সদস্যবৃন্দ একত্র হস্তান্তরযোগ্য সহানুপাতিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজ নিজ প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে।
(৪) দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে ৯৩ জন প্রতিনিধি পাঠানো যাবে।
৪. নির্বাচনের মাধ্যমে
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে গণপরিষদ গঠন করার জন্য এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চিফ কমিশনার শাসিত চারটি আসন সময় ব্রিটিশ ভারত থেকে মোট ২৯৬ জন প্রতিনিধি নির্ধারণের জন্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে দলগত বিচারে কংগ্রেস সতর্ক করা ৬৯ ভাগ আসল নামের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ ২৯২ টি প্রাদেশিক আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ২৩৮টি এবং মুসলিম লীগ পায় ৭৩ আসন।
উপসংহার
সংবিধান রচনার লক্ষ্যে গঠিত খসড়া কমিটি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করে। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর রচিত হয় ভারতীয় সংবিধান।
ভারতীয় গণপরিষদের লক্ষ্য
সূচনা
সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতের আর্থ ও সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি। এর পাশাপাশি ভারতের সংবিধান ন্যায়বিচার, স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশ, স্বাধীনভাবে ধর্মচরণ ইত্যাদির অধিকার দিতে চেয়েছিল ভারতীয় নাগরিকদের। সকল নাগরিক যাদের সমান সুযোগ পায় এবং সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, গণপরিষদের সদস্যগণ উদ্দেশ্য রূপে গ্রহণ করেছিলেন। প্রত্যাখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসুর মতে-আপন বিশিষ্টতার জন্যই ভারতীয় সংবিধান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংবিধানের থেকে স্বতন্ত্র।
ভারতীয় সংবিধানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য গুলি হল –
১. আর্থসামাজিক উন্নতি
গণপরিষদের সর্ব প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতের আর্থ সমাজ অবস্থার উন্নতি ঘটন। জহরলাল নেহেরু বলেছিলেন ভারতের নবগঠিত সংবিধান জাগাবে, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেবে এবং প্রত্যেকের আত্ম বিকাশের ব্যবস্থা করবে। ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ বলেন গণপরিষদের মূল লক্ষ্য হবে ভারতের আর্থসামাজিক বিপ্লব সাধন।
২. গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন
ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ গণপরিষদের রাজনৈতিক লক্ষ্য বর্ণনা করে বলেন যে ভারতের আত্মপ্রকাশ করবেন এক স্বাধীন, সর্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র হিসেবে। যেখানে থাকবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব।
৩. সামাজিক লক্ষ্য
সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তপশিলি জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, শিশু ও নারী কল্যা, অস্পৃশ্যতা বিলও বিদ্যাদী বিষয়গুলি গণপরিষদের বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
উপসংহার
ভারতীয় গণপরিষদ ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও জনগণের অর্থ সামাজিক স্বার্থ সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ে কতটা যে আন্তরিক ছিল তা বোঝা যায় সংবিধান প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে। বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ এস.সি. ক্যাপশন তার ‘our Construction ‘ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, “এটা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়েছে এর উচ্ছলতা, গতিশীলতা ও প্রগতিশীলতার মধ্যে।