‘ষে অপরিচিতা মধুর হাসিনী বিদেশিনী কবিকে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রায়’ আকর্ষণ করেছেন, এবং কোনো নিরুদ্দেশের দিকে নিয়ে চলেছেন কবিতাটি পর্যালোচনা করে তা বুঝিয়ে দাও।

কবিতাটির নাম ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। বিষয়বস্তু সমীক্ষায় দেখা যায়, কোনো এক বিদেশিনী, মধুর হাসিনী নারীর নৌকাতে কবি নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়েছেন। কবির সেই নিরুদ্দিষ্ট পথে যাত্রা প্রসঙ্গটি কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষিত। উত্তম পুরুষে বিবৃত বক্তব্যে কবি যখনই তরুণীর কর্ণধার নারীকে গন্তব্যস্থল সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন তখন সেই রহস্যময়ী নারী নীরব থেকে রহস্যময় স্নিগ্ধ মধুর হাসির ওপর দিয়েছে। এর থেকে গন্তব্যস্থলের নির্দিষ্ট স্থান অবগত হওয়া সম্ভবপর হয়েছে, সেদিক থেকে কবিতার নাম * নিরুদ্দেশ যাত্রা সার্থকতার সঙ্কেত বহন করে এনেছে। অর্থাৎ অন্তসূর্যাভা সম্পর্কিত সাগরের ওপর দিয়ে প্রত্যাসন্ন সন্ধ্যার অভিমুখে সোনার তরী অগ্রসরমান নিরুদ্দেশ যাত্রায়। উত্তমপুরুষে বিবৃত এই কবিতায় নেই অকাল কর্তিত ফসল নিয়ে ঘনবর্ষার জলবেষ্টিত ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে অপেক্ষামান উদ্বিগ্ন কৃষকের রূপকশায়িত আড়াল। তরীর যাত্রী কবি-পরিণাম শঙ্কাব্যাকুল অথচ, রহস্যমুগ্ধ। তরঙ্গ চঞল জলরাশির ওপর দিয়ে অগ্রসর তরীর কর্ণধার এক নারীরহস্যাবৃত নিরুদ্বেগ। গন্তব্যস্থল না জানালেও কবি সেই রহস্যময়ীর মোহনসঙ্গ স্বীকার করে তরীর যাত্রী হয়েছেন, তাই কবিতার নাম ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা।

রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য ব্যাকুলতার মমার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতায়। কবিতার শুরু থেকে আমরা রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাই। তাঁর সৃষ্টির প্রথম দিকে রোমান্টিকতার আতিশয্য ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা রোমান্টিকতার অভিযোগ তিনি অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। গোধূলি পর্বের সৃষ্টি প্রৌঢ় ঋতুর ফসল নবজাতকের মধ্যে তা অবগত হওয়া যায়। রসতীর্থ পথের পথিক হিসাবে তিনি যে রোমান্টিক সেকথা অকপটে স্বীকারোক্তি রোমান্টিক কবিতাকেই মেলে। সোনারতরী মানস সুন্দরী এবং নিরুদ্দেশ যাত্রা এই তিনটি কবিতাতে তার রোমান্টিক সৌন্দর্য ভাবনার স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। সোনার তরীতে এই রোমান্টিক প্রেম ভাবনার অঙ্কুরোদ্গম, মানস সুন্দরীতে তার পরিপূর্ণ সত্তার প্রকাশ আর নিরুদ্দেশ যাত্রায় সেই রহস্যময়ী নারীর সৌন্দর্য ব্যাকুলতার অনিন্দ্য সুন্দর অভিব্যক্তি।

যাকে আমরা পেতে চাই, নিবিড় বাহু বন্ধনে, ধরতে চাই; যার সঙ্গে মিলন মধুর উপভোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই সে নিজেকে মানস সরোবরের অগম্য তীরে আবদ্ধ রেখেছে। সেখানে সশরীরে পৌঁছানো যায় না, দূত হিসাবে পাঠানো যায় কল্পনাকে। রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে এই রকম এক ভাবনার প্রকাশ রেখেছিল, নিরুদ্দেশ যাত্রার সেই কল্পলোকের রহস্য মমতা আছে বলেই কবিতাটি রোমান্টিক প্রেম সৌন্দর্যের তথা নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষার সৌন্দর্য অনুধাবনের কবিতা হতে পেরেছে। সমালোচক তাই এ কবিতার রোমান্টিক প্রসঙ্গ সমীক্ষায় লিখেছেন—“যেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেই তির অগণ্য তির এবং সেখানে সশরীরে উপনীত হওয়ার কোনো পথ নেই বলেই, কবি যে সৌন্দর্যলোকে পৌঁছতে চান, যে সৌন্দর্যময়ী সত্তার সঙ্গে মিলিত হতে চান, তাকে পান না বলেই জাগে বিরহ বেদনা—রোমান্টিক সৌন্দর্য ব্যাকুলতা।

কবিতাটিকে রহস্যময়ী নারীর রহস্যময়তার সৌন্দর্যের যে চলচিত্র কবি তুলে ধরেছেন, সে জিজ্ঞাসার বৃত্তে বার বার অনুরণিত হয়েছেন তার দ্বারা কবির নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের রহস্যময়তা। স্পষ্ট বিরাজ করেছেন দুটি ক্ষেত্রে প্রথম জিজ্ঞাসা—“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী ?” দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা—“কী আছে হোথায়—চলেছি কীসের অন্বেষণে ?” এরকম অজস্র জিজ্ঞাসা কবিতাটির স্তরে স্তরে বিকশিত। এই জিজ্ঞাসার আলোকে রহস্যময় সৌন্দর্য অনুধ্যান তথা নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এ কবিতার উপভোগ্য মাধুরীর স্বাদে মেলে। কবি কল্পনার মধ্যে আছে রহস্যময়ী এক নারীর পরিকল্পনা, সোনার প্রেম সৌন্দর্যের রহস্যময়তা নিয়ে বিকশিত। সে যেন ধরা ছোয়ার বাইরে, এই মধুরহাসিনী বিদেশির ডাককে কবি অস্বীকার করতে পারেননি। তাই প্রথম ডাকেই নবীন প্রাতে কবি সাড়া দিয়েছে। কবির জিজ্ঞাসার নিরসন অবশ্য হয়নি, কবি যখন জানতে চেয়েছেন—

আছে কি হোথায় নবীন জীবন

আশার স্বপন ফলে কি হোথায় সোনার ফসল?

তখন মৃদু মধুর হাসিনী বিদেশিনী কবির মুখপানে চেয়ে স্নিগ্ধ মধুর হাসি ছাড়া অন্য কিছু দেয়নি।

প্রেম সৌন্দর্যের আধার যেখানে নারী সেখানে তার মধ্যে রমণীয় রহস্যময়তা থাকাই স্বাভাবিক, নিরুদ্দেশ যাত্রার বিদেশিনী সেই রমণীয় রহস্যময়তা নিয়ে কবিতাটিকে উপভোগ্য রসের মাধুর্যে ভরে দিয়েছে। কবির কাছে তাই তার প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব নেই। অবশ্য না থেকেও সে আছে—এখানেই রহস্যময়ী নারীর রসাস্বাদের অনুভূতিময়তা। কবি অনুভবে তার অভিব্যক্ত—

শুধু ভাসে তব দেহ সৌরভ

শুধু কানে আসে জল কলরব 

গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তার

কেশের রাশি৷৷

সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। উর্মিমুখর সাগরের পাড়ে মেঘচুম্বিত অস্তগিরির চরণতল। এখানে ঝলসে উঠেছে জল তরল অনলবৎ হু হু করে বয়ে চলেছে বাতাস, শোনা যাচ্ছে জলোচ্ছ্বাসের গর্জন, এ রকম পটভূমিকায় নীরব হাসিনী নারী নিরুদ্দেশের পথে নিয়ে চলেছে কবিকে। এ যাত্রা তো কোনো নির্দিষ্ট সঙ্কেত কাজের যাত্রা নয়। কোথায় চলেছে সোনার তরী তা জানেন না কবি। সঙ্গিনীও কিছু বলছে না তাঁকে। কবি বারেক জিজ্ঞাসা রেখে যখন বলেন—

স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায় 

আছে কি শান্তি আছে কি সুপ্তি

তিমির তলে?

তখন সোনার তরীর নারীবেশীনি কাণ্ডারীর কথা না বলে নয়ন তুলে মৃদু রহস্যময় মধুর হাসির ঝিলিক উপহার দেয়। এ রমণী রহস্যময়ী এক রমণী, আঁধার রজনিতে যখন সন্ধ্যাকাশে স্বর্ণালোকে ঢাকা পড়ে থাকে তখন তাকে দেখা না গেলেও তার অস্তিত্ব অনুভব করা যাবে । আসলে এ নারী যেন কবির নিরুদ্দেশ যাত্রায় মূর্তিময়ী প্রতিমা। তাইতো নিরুদ্দেশ যাত্রীর সঙ্গিনী প্রসঙ্গে কবির উপলব্ধি— 

বিফল হৃদয় বিবশ শরীর 

ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর 

কোথা আছে, ওগো করহ পরশ 

নিকটে আসি।

কবিতাটির কাব্যমূল্য অসাধারণ। কেবল ছন্দ লালিত্যে অলংকার ঝংকার সুষমায়, রোমান্টিক রহস্যময়তার, প্রতীকি ব্যঞ্জনা ধর্মিতায়, প্রেম চেতনায়, অতলান্তিক ভাব গভীরতার এ কবিতার কাব্য সৌন্দর্যের অসাধারণত্বের দিকটি স্বীকৃতি পায়নি। এছাড়াও কবিতার কাব্য সৌন্দর্য সমৃদ্ধিতে আরও কিছু দিক কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে। এর গীতিকাব্যিক আবেদন এবং চিত্রকল্পের উপস্থাপন কৌশল কবিতাটিকে অতি উৎকৃষ্ট মানের কবিতার মর্যাদাতে উন্নীত করেছে। ড. রামজীবন আচার্যের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে কবিতাটির কাব্যমূল্যের যথার্থ স্বরূপ সমীক্ষাও “নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতার কাব্যশৈলীর মাধুর্য প্রশ্নাতীত। এখানে শ্রুতিসুখকর শব্দচয়ন আছে, আছে সুরেলা ছন্দোবন্ধন, এগুলি গীতিকাব্যের বিশেষ অঙ্গ। ব্যক্তিনিষ্ঠ চেতন, মধুর রস আর্দ্রতা, দুর্ত্তেয় অস্ফুটতা, কল্পনার দূর যাত্রা সৌন্দর্যানু সন্ধান, চিত্রশিল্প, লালিত শব্দাবলি ও ছন্দ্যেব্যবহার কবিতাটিকে সুখপাঠ্য গীতি কবিতার সমুর্ত্তীর্ণ করেছে।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment