‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ চরিত্র
জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করতে বসে শ্রীকান্তের স্মরণে এসেছিল ইন্দ্রনাথের কথা— “কিন্তু কি করিয়া ‘ভবঘুরে’ হইয়া পড়িলাম, সেকথা বলিতে গেলে, প্রথম জীবনে এ নেশাকে যে মাতাইয়া দিয়াছিল, তাহার কিছু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। তাহার নাম ইন্দ্রনাথ।” সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বালানাের আগে সকালবেলার সলতে পাকানাের প্রভাতী ইতিহাস যেখান থেকে শুরু, সেই প্রভাতী ইতিহাসে কক্ষচ্যুত নক্ষত্র। ইন্দ্রনাথকে শিশু বলে শুরু করা হলেও সে শিশু নয়। শ্রীকান্তের সঙ্গে পরিচয়ের সময় তার শৈশব অতিক্রান্ত, সে তখন কৈশােরে পদার্পণ করেছে। কিন্তু তবু তার মধ্যে যে সকল বৃত্তি সমধিক বিকশিত সেগুলি শিশুসুলভ সন্দেহ নেই। শিশু মনের সাহস, নির্লিপ্ততা, চঞ্চলতা, পরােপচিকীর্ষা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে অতুলনীয় হয়ে উঠেছে ইন্দ্রনাথ চরিত্রখানি।
প্রথমেই ইন্দ্রনাথ তার সাহস আর সরলতার জোরেই পাঠকের দৃষ্টি অর্জন করে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সে পড়েছে ; খেলার মাঠে মারামারি ; গঙ্গার উজান বেয়ে শুয়াের প্রভৃতি বন্য জন্তুর পথে সঞ্চরণ এসব তার অভ্যস্থ জীবন যাত্রার অঙ্গ। সমস্ত বিপদের ওপর সে বিজয়কেতন উড়িয়েছে। কঠিন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সে সংগ্রাম এমনই অনায়াস যে মনে হয় যা অপরের কাছে প্রতিকূল তা তার কাছে অনুকূল। মাছ চুরির সময় পালাবার যে পথ সে বাতলেছে তা শুনে শ্রীকান্ত ভয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে। অর্থাৎ নিঃশঙ্ক সাহসই ইন্দ্রনাথকে স্বতন্ত্র বিশিষ্টিতা দান করেছে। যেমন, শ্রীমা বহুরূপীকে আবিষ্কার এ কথাই প্রমাণ করে। ইন্দ্রনাথের সাথে শ্রীকান্তের প্রথম পরিচয়ের ঘটনাতে শ্রীকান্ত তার সাহস ও জোরের পূজারী হয়ে ওঠে। খেলার মাঠে যেভাবে ইন্দ্র তাকে বাঁচিয়েছিল তাতে শ্রীকান্তের পক্ষে কখনাে ভােলার নয়।
ইন্দ্রনাথের চেহারা শ্রীকান্তের চোখ দিয়ে এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে- “ছেলেটি ভালাে। তাহার বাঁশির মতাে নাক। প্রশস্ত সুডৌল কপাল, মুখে দুচারিটা বসন্তের দাগ।” ইন্দ্রের মধ্যে যে আছে একটা বড়াে শিল্পী সত্তা, তার প্রমাণ মেলে তার সুন্দর বাঁশি বাজানাে থেকেই। অথচ এই ইন্দ্রই ‘কলম ফেলিয়া সৌকার দাঁড় হাতে তুলিল’। তবুও ইন্দ্রের সঙ্গ পাবার জন্য শ্রীকান্তের মন ও দেহের প্রতিটি কণা উন্মুখ হয়ে ওঠে। ইন্দ্র কিশাের বীর সন্দেহ নেই। কিন্তু কখনােই বীরত্বের আস্ফালন তার মধ্যে দেখা যায় না। ঘৃণিত চরিত্র নতুনদাকে রক্ষা করতে সে পিছপা হয় না। যত অন্যায়ই করুক সে যে বাঘ তাকে নিয়ে গেছে, তাকে আক্রমণ করত হবে এবং সম্ভব হলে নতুনদাকে রক্ষা করতে হবে। এই সংকল্পইতাে ইন্দ্রনাথকে বীরােচিত সন্ধানে ভূষিত করে।
ইন্দ্রের বীরত্ব সম্পর্কে আমরা যতটা নিঃসংশয়, ততটা সংশয় জাগে তার মধ্যেকার অবিশ্বাস ও কুসংস্কার দর্শনে। কালীর জবাফুলে আসক্তি, রামনামের মাহাত্ম, ভক্তিপ্রেতের অস্তিত্বে তার অটল বিশ্বাস। কিন্তু শিশুর সরলতা ও সারল্যের পাশে বিরাজ করছে। মহামানবের বলিষ্ঠতা। যখন তার পরােপচিকীর্ষা জেগে ওঠে তখন সে অতি সহজেই সব সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে পড়ে। শাহজীর আজগুবি গল্পে সে বিশ্বাস করতাে। অন্নদাদিদির কাছে সে যেতাে নানা ভৌতিক বিদ্যা আয়ত্ত করতে। তবে ইন্দ্রনাথের এই অন্ধ বিশ্বাস আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতাে তাকে দুর্বল করেনি। অন্নদাদিদির প্রতি তার ভালােবাসা যে অকৃত্রিম তার প্রমাণ মেলে শাহজীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখে। সে প্রকাশ্যেই বলে উঠেছে- “আমি ওকে পুলিশে দিয়ে তবে ছড়াব না হলে দিদিকে ও খুন করে ফেলবে, ও খুন করতে পারে।”
ইন্দ্রনাথ অন্নদাদিদিকে কতখানি ভালােবাসতাে তা সে নিজেই জানতাে না। অন্নদাদি যখন নিজের সংসারে সুস্থিরতা ফিরিয়ে আনতে যখন ইন্দ্রকে মাথায় হাত দিয়ে শপথ করিয়ে নেয় তাদের বাড়িতে আর যেন তার কখনাে না আসে তখন- ‘ইন্দ্র, প্রথমটা অবাক হইয়া রহিল। কিন্তু পরক্ষণেই আগুনের মতাে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, তা বটে। আমাকে খুন করতে গিয়েছিল সেটা কিছু নয়, আর আমি যে তাকে বেঁধে রেখেছি, তাতেই তােমার এত রাগ ! এমন না হলে কলিকাল বলেচে কেন ? কিন্তু কি নেমকহারাম তােমরা দুজন! আয় শ্রীকান্ত, আর না।’ কিন্তু ইন্দ্রনাথ যাবে কোথা? অন্নদাদিদি ছাড়া সেতাে কিছু ভাবতে পারে না, তাইতাে ক্ষণিকের রাগ সম্বরণ করতে না পেরে সে শ্রীকান্তকে নিয়ে অন্নদাদিদির বাড়ি থেকে চলে আসে বটে, আবার কয়েকদিন পরেই তাকে সেখানে রওনা দিতে হয় এটাই অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালােবাসার মাহাত্ম্য।
এযাবৎ আমরা জানালাম, ইন্দ্রনাথ খুদে বীর, সাহসী পরােপকারী। কিন্তু এই গুণাবলী যে তাকে কি ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখে দাঁড় করিয়েছিল তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। গঙ্গায় ভাসমান ছােটোজাতের শিশু-মৃতদেহকে নৌকায় তুলতে গিয়ে শ্রীকান্তের প্রশ্নের জবাবে বলে উঠেছিল— ‘আর এযে মড়া! মড়ার আবার জাত কি?’ মৃত্যু সম্পর্কে সে বিশেষ উদাসীন তা প্রমাণ রয়েছে ভুট্টা জনারের ক্ষেতের মাঝে ‘ছপাৎ’ শব্দে ভীত সন্ত্রস্ত শ্রীকান্তকে সাহস রাখতে বলে উঠেছিল “ও কিছু না সাপ জড়িয়ে আছে ; তাড়া পেয়ে জলে ঝাপিয়ে পড়েছে।” শ্রীকান্ত যখন সাপের কামড়ানাের ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে। ইন্দ্রনাথ কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে বলে ওঠে- “আর কামড়ালেই বা কি করবাে ; মরতে একদিন তাে হবেই ভাই।” সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌছে বােধকরি কোন মানুষের কণঠে এমন বাণী উচ্চারিত হতে পার। তাইতাে শ্রীকান্ত অবাককণ্ঠে বলে উঠেছিল— “ওই লােকটি কি। মানুষ ? দেবতা? পিশাচ ? কে ও ? কার সঙ্গে এই বনের মধ্যে ঘুরিতেছি।”
ইন্দ্রনাথের মতাে কিশাের বালকের এই স্বার্থপর পৃথিবীতে টিকে থাকার স্থানের। বড়াে অভাব। তাইতাে তাকেও সকলের অগােচরে বিদায় নিতে হয়। “এমনিভাবে একদিন অতি প্রত্যুষে ঘরবাড়ি বিষয় আশয়, আত্মীয়স্বজন সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া সেই যে এক বস্ত্রে চলিয়া গেল, আর কখনাে ফিরিয়া আসিল না।” শ্রীকান্ত তার বাল্যবন্ধুকে মহাপ্রাণ বলে আখ্যাত করেছে এবং সৃষ্টি কর্তার কাছে নালিশ জানিয়েছে “ভগবান! টাকাকড়ি, ধন দৌলত বিদ্যাবুদ্ধি ঢের তাে তােমার অফুরন্ত ভাণ্ডার হইতে দিতেছ দেখিতেছি, কিন্তু এত বড় একটা মহাপ্রাণ আজ পর্যন্ত তুমি তাে কটা দিতে পারিলে?” এই প্রশ্নের কোনাে উত্তর নেই। ইন্দ্রনাথকে হারিয়ে তাই যেমনভাবে শ্রীকান্তকে বিরাট পাহাড় সমান একটা ব্যথা বুকে চেপে তার বাকি জীবনটা কাটাতে হয়েছিল রসপিপাসু পাঠক ও শ্রীকান্তের মতােই একই যন্ত্রণা বােধ করে।