রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ কাব্যধর্মী উপন্যাস। দুজন তরুণ তরুণীর অসার্থক প্রেম-গাথা এ উপন্যাসের মূলীভূত বিষয়। অসার্থক প্রেম এই অর্থে লাবণ্য অমিতর প্রতি তার প্রেম ‘প্রত্যহে স্নান স্পর্শ’ থেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসে অমিতের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। প্রেম ও বিবাহের পার্থক্য সম্বন্ধে তার সচেতনতা প্রকাশ পেয়েছে। উপন্যাসের লাবণ্যতর্ক অংশে। প্রতিদিনের বাসনায় সে অমিতকে বাঁধতে চায়নি। বস্তুত, লাবণ্য তার প্রেমের দ্বন্দ্বে উপলব্ধি করতে পেরেছিল, অমিত যে লাবণ্যকে ভালােবাসে সে লাবণ্য তার মানস সৃষ্টি, বাস্তবের লাবণ্যের সাথে তার কোনাে মিল নেই। লাবণ্যর ভাষায়— ‘কথা দিয়ে উনি কেবলই আমাকে গড়ে তুলেছেন। ওঁর মন যদি ক্লান্ত হয়, কথা যদি ফুরােয় তবে সেই নিঃশব্দের ভিতরে ধরা পড়বে এই নিতান্ত সাধারণ মেয়ে যে মেয়ে ওঁর নিজের সৃষ্টি নয়।’ সুতরাং, অমিত ‘সে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়’ তার ‘মানস ভােজের’ জন্য সযত্নে সাজিয়েছে তাকে লাবণ্য তার ‘ধুলির ধন’ দিয়ে ধুলিলুষ্ঠিত করতে চায়নি। সে জানে বিবাহবন্ধনে যাকে পাওয়া বলে- “সে আর কিছু নয়, হাতকড়া হাতকে যেমন পায় সেই আর কি”। লাবণ্যর চেতনায় তখন এ কথাই সত্য হয়ে উঠবে- “বাহুলতা শুধু বন্ধন পাশ, বাহুতে মাের।”
রবীন্দ্রনাথের রচনায় প্রেমের বিচিত্র অনুভূতি লক্ষিত হয়। সুতরাং, শুধু লাবণ্য কেন, শােভনলাল ও অমিতের প্রেমানুভূতিও রবীন্দ্রকাব্যে বিরল নয়। শােভনলালের ভীরু প্রেমের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় লাবণ্যর মনের দুয়ারে আঘাত করার শক্তি তার ছিল না। প্রেমের উপহার নিয়ে সে লাবণ্যের দুয়ারে উপস্থিত হতে পারেনি, বােবা ব্যথা নিয়ে বারেবারে ফিরে এসেছে। শােভনলালের ক্ষেত্রেও তাই, তবে তার ভীরু প্রেমাঞ্জলির আকর্ষণ লাবণ্য শেষ অবধি উপেক্ষা করতে পারেনি। আর লাবণ্যের প্রত্যাগমনে স্বল্পবাক, শােভনলালের বক্তব্য শেষের কবিতায় অনুক্ত রয়েছে। কল্পনায় তা ভরিয়ে নিতে হবে। অমিতের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, লাবণ্যর সঙ্গে তার দেখা হওয়ার মুহূর্তেই সে প্রেমের যথার্থ আলােড়ন অনুভব করেছিল। ইতিপূর্বে মেয়েদের প্রতি তার পক্ষপাতটা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল। অমিতের বক্তব্য- “সমাজের কাটাখাল বেয়ে বাঁধা ঘাটে রুটির লণ্ঠন জ্বালিয়ে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সে পরিচয়ে দেখা শােনা হয় চেনা শােনা হয় না।”
শিলঙ-পাহাড়ে লাবণ্যর সাথে প্রথম সাক্ষাতে অমিতের মনে যে সুর বেজে উঠেছিল তা সে এমনভাবে ব্যক্ত করেছে তার নােটবইয়ে পথ আজ হঠাৎ একী পাগলামি করলে। দুজনকে দুজায়গায় থেকে ছিড়ে এনে আজ থেকে হয়তাে একরাস্তায় চালান করে দিলে ।.. চলার বাঁধন আর ছেড়ে না। অন্যদিকে শােভনলালের প্রেম নীরব আত্মদানের সার্থকতার সন্ধান করেছে। প্রেমের জগতে শােভনলাল ও অমিতের স্থান প্রতীপ মেরুতে। লাবণ্য যে জীবনের প্রথম লগ্নে শােভনলালকে প্রত্যক্ষ করেনি তার কারণ বিশ্লেষণে লেখক বলেছেন- “দ্বিধা করে নিজেকে যে পুরুষ যথেষ্ট জোরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ না করায় মেয়েরা তাকে যথেষ্ট স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করে না।” লাবণ্যর প্রতি তার নীরব প্রেম সে মনের গহনে লালন করেছে দীর্ঘদিন, যার ঘর কেউ জানেনি।
অমিত ও শেষপর্যন্ত লাবণ্যর সুরে সুর মিলিয়ে তার প্রেম চিরন্তন করে রাখে। “তব অন্তর্ধান পটে হেরিতব রূপ চিরন্তন।” অর্থাৎ এখানে দুই মুখ্য চরিত্র অমিত ও লাবণ্যর প্রেম যে বিন্দুতে শুরু হয়েছিল সেই বিন্দুতেই ফিরে এসেছে। অমিতের প্রেমবৃত্তের শুরু কেটিকে দিয়ে। অক্সফোর্ডে, যখন কোটির বয়স আঠারাে, যখন কেটির হাতে অমিত আংটি পরিয়ে দিয়ে কীটসের একটি পংক্তি আবৃত্তি করেছিল। আর এই বৃত্তের শেষেও কেটিকে দিয়েই যখন নৈনিতালের সরােবরে নৌকা ভাসিয়ে কেটি তার হাল ধরেছে আর অমিত তাকে পড়ে শােনাচ্ছে রবিঠাকুরের নিরুদ্দেশ যাত্রা। অথচ এই বৃত্তের পরিধির প্রায় সমস্তটাই জুড়ে রয়েছে, কেটি নয়, লাবণ্য এবং বৃত্তের কেতকী বিন্দুতে অমিতের ফিরে আসার পিছনেও লাবণ্যর অবদান রয়েছে। অন্যদিকে, লাবণ্যর প্রেম বৃত্তের প্রথম বিন্দু শােভনলাল এবং শেষ বিন্দু ও সে, কেবল বৃত্তের সঞ্চার পথের অন্যসব বিন্দুগুলিতেই রয়েছে অমিতর অবস্থান। আর, যে লাবণ্য শােভনলালের কাছে ফিরে গিয়েছে সে লাবণ্য অমিতের প্রেমের স্পর্শে পরিবর্তিত। সে লাবণ্য- ‘ভালোবাসা কে দুর্বলতা বলে মনে মনে ধিক্কার দিয়েছে’ সে লাবণ্য, বৃত্তের পরিণতিতে শােভনলালকে জীবনে বরণ করে নিয়েছে। তার বক্তব্য—চাইনে বলে ফিরিয়ে দিতে পারি এমন শক্তি নেই আমার, এমন অহংকার ও নেই।
উপন্যাসের সমাপ্তিতে ‘কালের যাত্রার ধ্বনির’ মধ্যে রাতের চল বেগের মধ্যে, জীবনের ও প্রেমের অবিরাম ও অবধারিত পরিবর্তনের যে দর্শন প্রেমের পরিণতির পক্ষে প্রচারিত হয়েছে তার বিভিন্ন বিচিত্র সংকেত কাহিনির মধ্যে ছড়ানাে রয়েছে। তাই উপন্যাসের প্রেম পরিণতি ও আকস্মিক নয়। রবীন্দ্রনাথ একদিকে ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে, অপরদিকে দার্শনিকতা ও কাব্যিক ব্যঞ্জনার সূক্ষ্ম সহায়তায় শেষের কবিতার পরিণত, পর্ব থেকে পর্বান্তরে,স্পষ্টতর করে তুলে, সঙ্গত সমাপ্তিতে এসে পৌঁছেছেন। অমিত বলেছিল— ‘রবি ঠাকুর কেবল চলে যাবার কথাই বলে, রয়ে যাবার গান গাইতে জানে না।’ তাঁর সব রচনাতেই চলে যাবার কথা বলেন কিনা, অমিতের সঙ্গে সে তর্কে অবতীর্ণ না হয়ে এটুকু স্বীকার করা চলে যে, শেষের কবিতা সত্যিই চলে যাবার গান। আর সে গান মূলত লাবণ্যকে কেন্দ্র করেই তিনি গেয়েছেন।
সব মিলিয়ে বলতে হয়, অমিতের জীবন থেকে বিদায় বার্তা ঘােষণা করতে লাবণ্য যে কবিতাখানি রেখেছে-
“কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও
তারি রথ নিত্যই উধাও…..”
তাতে বিষাদের সুর যতই ধ্বনিত হােক না কেন, একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে রচনায় বিশেষ সহায়ক হয়েছে। লাবণ্য চলে গেছে শােভনলালের নিবেদিত প্রেমকে সার্থক করতে, আর অমিত ফিরে এসেছে তার পূর্ব প্রণয়ী কেতকীর কাছে। মাঝে অমিত লাবণ্যর সে মধুর সান্নিধ্য মধুর ভাব বিনিময়ের অবসানে সূক্ষ্ম স্মৃতির ধারকরূপে শেষের কবিতাটি বড়াই মূল্যবান। তাই শেষের কবিতাটি যে উপন্যাসের নামকরণকে যথার্থ সার্থক করে তুলেছে বলাই বাহুল্য।