“শাক্ত পদাবলী কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মের কাব্য নহে, ভক্ত-হৃদয়ের আন্তরিক অনুরাগেই স্বচ্ছন্দ প্রকাশমাত্র।”—’ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদসমূহ হইতে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতিসহ তাৎপর্য বুঝাইয়া দাও।
শাক্ত কবিমাত্রেই ভক্ত এবং তাদের সব পদেই এক জাতীয় আকৃতির প্রকাশ ঘটেছে। ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পাঠ্যপদগুলি অবলম্বনে এই আকৃতির স্বরূপ ব্যাখ্যা করো।
শাক্তপদে ভক্তিরস
অষ্টাদশ শতকের ঘোরতর সঙ্কটময় পরিবেশের মধ্যে সাধককবি রামপ্রসাদ সেন ভক্তের আকুতি নিয়ে যে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন, সেই ধারাটি আধুনিক কাল পর্যন্তই সচ্ছন্দ গতিতে চলে এসেছিল। একালে আমরা বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে আপাত-সাদৃশ্য লক্ষ্য করে ঐ পদগুলিকে শাক্তপদাবলী’ নামে চিহ্নিত করেছি। তার ফলে পদগুলির ওপর একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ছাপ পড়ে গেল। কাজেই স্বভাবত মনে হতে পারে, এই পদগুলিতে শক্তি-সাধনার আনুষ্ঠানিক আচারাদির পরিচয় থাকা সম্ভবপর। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বিচার করলে দেখতে পাই, শাক্তপদাবলীর দুটি প্রধান ধারার কোনটিতেই আনুষ্ঠানিক ধর্মবোধের কোন চিহ্ন নেই দুই ধারাতেই ভক্ত-হৃদয়ের আন্তরিক অনুরাগ তথা ভক্তিরসেরই অবারিত। স্রোেত লক্ষ্য করা যায়, যদিচ রূপে অর্থাৎ প্রকার প্রকরণে তারা পৃথক্।
শাক্তপদাবলীর প্রধান ধারা দুটি— ‘উমাসঙ্গীত’ তথা আগমনী-বিজয়ার গান, অপরটি “শ্যামাসঙ্গীত—এর দুটি প্রধান উপধারার একটিতে জগজ্জননীর রূপ, অপরটিতে ভক্তের আকৃতি বর্ণিত হয়েছে। সমস্ত শাক্ত পদাবলীতেই মাতা ও সন্তানের পারস্পরিক সম্পর্কটিকেই নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। হাদয়গত যে সম্পর্কটি দুটি মানব হৃদয়কে এক অভিন্ন সূত্রে সংগ্রথিত করে থাকে, তাকে আমরা বাংলায় এক কথায় বলতে পারি ‘ভালবাসা।’ পাত্রভেদে এরই রয়েছে বিভিন্ন নাম–বৈষ্ণবপদে কৃষ্ণের সঙ্গে সখাদের সম্পর্ককে বলা হয়েছে ‘সখ্যরস’, রাধাকৃষ্ণের প্রেমের নাম ‘মধুর রস’ বা ‘শৃঙ্গার রস, শাক্ত পদাবলীতে সন্তানের প্রতি মাতার স্নেহ ‘বাৎসল্যরস’ এবং জননীর প্রতি সন্তানের ভালবাসাকে বলা হয় প্রতিবাৎসল্য রস’ এবং এদের প্রত্যেকটিই মূলত ‘ভক্তিরস’।
‘শাক্তপদাবলীর আগমনী-বিজয়ার সঙ্গীতগুলিতে বাৎসল্যরসের ধারা উৎসারিত হয়েছে, তার বিপরীত ক্রমটি লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন শ্যামাসঙ্গীতে, বিশেষত ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ে। আগমনী-বিজয়াতে স্নেহের নিম্নগামী রূপ অর্থাৎ জননী থেকে সন্তানে যা প্রতিফলিত হয় সেই বাৎসল্যরসের পরিচয় বর্তমান। বৈষ্ণবপদে অনুরূপ কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে যশোদা ও বালগোপালের সম্পর্কের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের অন্যত্রও অপত্যস্নেহের দৃষ্টাস্ত দুর্লভ নয়, কিন্তু শাক্ত পদাবলীতে এর যা উৎসার লক্ষ্য করা যায়, তেমনটি আর কোথাও নেই। আবার ‘ভক্তের আকৃতিতেও জননীর প্রতি সন্তানের যে অকৃত্রিম ভক্তির নিদর্শন মাতৃপদে শরণ গ্রহণের যে আর্তি লক্ষ্য করা যায়, বৈষ্ণব পদাবলীর দু-একটি ‘নিবেদন’ পদে অনুরূপ আর্তি লক্ষ্য করা গেলেও জননীর সঙ্গে সস্তানের সেই হাদ্য সম্পর্কটি অন্যত্র দুর্লভ। শাক্তপদে ভক্ত-হৃদয়ের আন্তরিক অনুরাগের যেরূপ স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটেছে, তা যেমন বিচিত্র, তেমনি গভীর। বলা প্রয়োজন, শাক্তপদে ভক্তির রূপায়ণই শাক্তপদ কর্তাদের অভিপ্রায় ছিল, তাঁদের সাধন-তত্ত্বের স্বরূপ প্রকাশ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির বিবরণ দানের বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তাঁদের মধ্যে ছিল না।
শক্তি-সাধনা তান্ত্রিক সাধনারই একজাতীয় প্রকার ভেদ মাত্র। এই সাধনা গোপনীয়— ইয়া শাস্তবী বিদ্যা গোপ্যা কুলবধুরিব—এই বিদ্যা বা সাধনা কুলবধুর ন্যায় গোপনীয়, বাইরে এর প্রকাশ ঘটলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে প্রকাশান্মত্যুলাভঃ স্যান্নপ্রকাশ্যং কদাচন। কাজেই শাক্তপদকর্তারা সাধনার স্বরূপটিকে কাব্যরূপে প্রকাশ করবেন, এ কথা কল্পনাই করা যায় না। শাক্তসাধনার আস্তর দিকটি বিবেচনা করলে দেহসাধনাকে মেনে নিতে হয়—অর্থাৎ ভাব নিয়ে এই সাধনার আরম্ভ হলেও মূল সাধনাটি ক্রিয়াত্মক–ন্যাস, প্রাণায়াম, জপ, কুণ্ডলিনীযোগ ইত্যাদি ক্রিয়াযোগই শাক্ত সাধনায় আনুষ্ঠানিক রূপ। ‘ভক্তের আকুতি’তে এই আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট আকারে সমুজ্জ্বল মূর্তিতে সাধারণ পাঠকের দৃষ্টিতে ধরা দেয়, তা এর ‘ভক্তি’। এই পর্যায়ের কবিতায় আমরা কোনো সাম্প্রদায়িকতার কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো চিহ্নই খুঁজে পাই না। বরং এর উদার মানবিকতা, সমস্ত ধর্মমতের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান চেষ্টাই ‘সবে এক, একে সব বলে লক্ষ্য করে থাকি। রামপ্রসাদ কী অবলীলাক্রমেই না তার আরাধ্যা শ্যামা মাকে অনুরোধ করেন—
‘যেমন ক’রে রাসমণ্ডলে নেচেছিলি,
হাদি-বৃন্দাবন-মাঝে ললিত ত্রিভঙ্গ-ঠামে
চরণে চরণ দিয়ে, গোপীর মনভুলানো বেশে,
তেমনি তেমনি তেমনি করে।’
শ্যামা মাকে তিনি কত সহজেই শ্যাম’ রূপে গ্রহণ করে নিতে পারেন। শাক্তপদে আনুষ্ঠানিক ধর্মের পরিচয় থাকলে কখনো শ্যাম আর শ্যামার অভিন্নতা কল্পনা সম্ভবপর হতো না।
শাক্তপদকর্তাদের প্রার্থনীয় মাতৃস্নেহ। মাতৃরূপিণী জগজ্জননী ইচ্ছা করলে ভক্তকে ইন্দ্ৰত্বও দান করতে পারেন, কারণ তিনি ‘কুবেরের মা’—কিন্তু সাংসারিক বিষয় ভোগে শক্তিউপাসকের ঘোরতরবিতৃষ্ণা, বিষয়-বিষ তাদের নিকটকৃমি-কীটতুল্য প্রেমের জগতে শাক্তভক্তের পরম অভিপ্রেত বস্তু হল মাতৃচরণে শরণ, তথা ভক্তি যদি পাই শ্যামাপদ, হই না ধনে অভিলাষী। শাক্তপদাবলীতে ভক্তিই যে সাধকের একমাত্র অভিলষিত বস্তু এবং ‘ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের বিভিন্ন পদে পদকর্তাদের যে এই আকৃতিই ব্যক্ত হয়েছে, তার সমর্থন পাচ্ছি অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর বক্তব্যে— “শাক্তপদাবলীর প্রতিটি পদ ভক্তির রঙে রঞ্জিত; এই ভক্তির আকর্ষণে কৈলাসবাসিনী উমা ভক্তের হৃদয় হিমালয়ে নামিয়া আসেন, এই ভক্তিদ্বারা কুণ্ডলিনী জাগ্রত হন: ভক্তিতেই কুণ্ডলিনী উত্থাপিত হয়, ষটচক্র ভেদ করিয়া জীব শিবসন্নিধানে যাইতে পারেন। শক্তিসাধক যেখানে ভক্তিকেই সর্বস্ব জ্ঞান করিয়া ‘কালী’ ও ‘তারার’ নাম মহিমায় বিভোর হইয়াছেন। ভক্তি দ্বারা ক্রিয়াযোগকে মণ্ডিত করিয়াছেন, বৌদ্ধ সিদ্ধ সাধক সেখানে ভক্তি-বিরহিত জ্ঞান ও যোগের সাধনা করিয়াছেন; তাই একটি যেমন ভাবাবেগ উদ্বেল, অপরটি তুলনায় আবেগ-বর্জিত। শাক্তগীতি ভক্তির পদাবলী।”
শাক্ত পদাবলীর প্রবর্তক এবং শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন। রামপ্রসাদ ভক্তের আকৃতি পর্যায়ে যত পদ রচনা করেছেন, তাদের সব কটিরই শেষ কথা – মায়ের অভয় চরণে শরণ গ্রহণ। সংসারে নানারকম ঘটনা দুর্ঘটনা অনবরত ঘটছে, রামপ্রসাদ তার জন্য কখন আবদার করছেন, কখন অভিমান করছেন, কিন্তু আসল কথাটি সব সময় এক ও অদ্বিতীয় কখনও বলছেন, ‘এখন সন্ধ্যেবেলায় কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো। আবার কখন বলেন, ‘যদি রাখ পদে থেকে পদে পদে পদে বিপদ সারি। স্বয়ং মহাদেব মায়ের চরণতল অধিকার করেছেন বলে কবির ক্ষোভ ছিল স্থানের মধ্যে অভয় চরণ— তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি। মায়ের নাম নিয়ে, মায়ের অভয় চরণে আশ্রয় নিয়েও যখন নানা দুর্ভোগে পড়তে হয়, অভিমানে মায়ের ওপরই দোষারোপ করে বলেন, “ও মা যে জন তোমার নাম করে, তার কপালে ঝুলি বা কাথা।”—মাকে একান্তভাবে আপন ক’রে ভাবতে না পারলে, মায়ের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি না থাকলে রামপ্রসাদের পক্ষে এমন উক্তি করা সম্ভবপর হতো না।
শাক্তপদের অপর বিশিষ্ট কবি সাধক কমলাকাস্ত। উপাস্যা দেবীকে তিনিও মাতৃভাবে উপাসনা করেছেন এবং সর্বত্র ভক্তিনত চিত্তে তার চরণে শরণ নিয়েছেন। এই সংসার জীবনে নানাবিধ উপদ্রব সারাক্ষণ মনকে সন্ত্রস্ত করে রাখে- কবির নিকট এ থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় ‘তারা’ নাম— ‘জন্মজরা মৃত্যুহরা তারা নামে ছেঁচলে বাঁচে।’ কমলাকান্ত তার অস্তরে দেবীর যে আসন পেতে রেখেছেন “আমারই অন্তরে থাক মা, আমায়ে লুকায়ে) তাঁর কাছে তিনি নির্বাণ বা মুক্তি কিংবা স্বর্গ কামনা করেন না— ‘মা, না করি নির্বাণে আশ, না চাহি স্বর্গাদি বাস/নিরখি চরণ দু’টি হৃদয়ে রাখিয়ে।”
কবি দাশরথি রায় কয়েকটি শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন, তিনি তার পদগুলিতে দেবীর নিকট শুধু ভক্তিই কামনা করেছেন,— আগে বধ ব্রহ্মময়ী, মোর কুমতি রক্তবীজে, ও তোর ভক্ত দাশরথি,/অনুরক্ত হয় ঐ পদাঙ্গুজে। এবং তখন ‘আমি মনে মনে তুলবো জবা বনে বনে/মিশায়ে ভক্তি-চন্দনে, পদে দিব পুষ্পাঞ্জলি।।
ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল কয়েকটি অতিশয় উৎকৃষ্ট এবং বহু প্রচলিত শাক্তপদ রচনা করেছেন। ‘ভক্তের আকুতি পর্যায়ে তিনিও প্রেম-ভক্তিরই কাঙালী। তাই বলেন,—
‘ও মা ভক্ত চিত্তহরা, ডুবাও প্রেমসাগরে
….তুমি প্রেম উন্মাদিনী ও মা পাগলের শিরোমণি,
প্রেমধনে কর মা ধনী, কাঙ্গাল প্রেমসাগরে।।’
কুমার নবচন্দ্র রায় ‘ভক্তের আকৃতি পর্যায়ে কয়েকটি পদ রচনা করেছেন। তার পদগুলিতেও ভক্তহৃদয়ের আন্তরিক অনুরাগ স্বচ্ছন্দে প্রকাশিত হয়েছে—
‘মা মা বলে যত ডাকি, শুনেও ত মা শোন না কো
নরা এঙ্গি লাথি-খেকো, তবু দুর্গা বলে ডাকে।।’
এইভাবে বিভিন্ন পদকর্তার ‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের পদগুলির বিশ্লেষণে আমরা আনুষ্ঠানিক ধর্মের কোনো পরিচয় বা লক্ষণই খুঁজে পাই না। ভক্তহাদয়ের আকৃতিই এই পদগুলির উপজীব্য বলে ‘শাক্তপদাবলী’র সম্পাদক এ জাতীয় পদগুলিকে ‘ভক্তের আকৃতি’—এই সার্থক শীর্ষনামে চিহ্নিত করেছেন। ভক্তের হৃদয়ানুরাগ স্বচ্ছন্দভাবে শাক্তপদগুলিতে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘ভক্তের আকৃতি’ পদ-বিষয়ে এই উক্তি সর্বাংশ সার্থক।