রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসুন্ধরা কবিতার কাব্যশৈলী বিচার করো।

বসুন্ধরা কবিতা কবি রবীন্দ্রনাথের মর্ত্য প্রেমের অসামান্য দলিল। ‘ছিন্নপত্রে’ কবি বলেছেন—“এই পৃথিবী আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মতো। আমার কাছে চিরকাল নতুন…..যখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্র স্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করেছেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নতুন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনের উচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম। তখন পৃথিবীতে জীবজন্তু কিছুই ছিল না।”

জমিদারি তদারক করার জন্য পদ্মাতীরের জনজীবনের কাছাকাছি আসার সঙ্গে একদিকে এসেছিল সুখ-দুঃখ, বিরহ মিলন পূর্ণজীবনে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে পদ্মার অপার সৌন্দর্য তাঁর মনে জেগেছিল অন্যদিকে পদ্মার, অপার সৌন্দর্য তাঁর মনে লেগেছিল নিরুদ্দেশ সৌন্দর্য আকাঙ্ক্ষা। মায়ময় এই বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে কবি যে কীরূপ নাড়ির টান অনুভব করেন তা তাঁর বসুন্ধরা কবিতাতে স্পষ্ট। কবির ভাষা ব্যবহার ও বাহ্যিক সৌন্দর্যে কবিতাটি পাঠকের মধ্যে রসবেদন সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছে।

বসুন্ধরাকে কবি মাতৃরূপে দেখেছেন ; তার সঙ্গে একীভূত হতে চেয়েছেন। ছয়টি স্তবক পরিব্যাপ্ত এই কবিতায় কবির আত্মগত ভাবোচ্ছাস লক্ষ করা যায়। সূচনা করেছেন এই মর্ত্যলোকের, এই বসুন্ধরা মাতার কোলে আশ্রয় চেয়ে—

‘আমারে ফিরায়ে লহো, অয়ি বসুন্ধরে

কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে

বিপুল অঞ্চল তলে’

কবির ইচ্ছা এই পৃথিবীর মানুষ, প্রকৃতি, প্রাণীকুলের সঙ্গে একাত্মতার বন্ধনে আবধ্য হওয়া। বসুন্ধরা রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি এই প্রকৃতির সবকিছুকে দুহাতে আঁকড়ে ধরতে চান। কবি সঙ্গে এই বসুন্ধরার পরিচয় যেন দীর্ঘদিনের-এর অনুভূতি কখনও ভুলতে চান না। কবি মৃত্তিকা বন্ধনে যেন চিরকাল অবাধ্য হতে চান ; মৃত্যুর পরেও তিনি যেন প্রবৃত্তির কাছে অমরত্বের আশীর্বাদ চান। তিনি বসুন্ধরার স্তন্য সুধা পান করে এই বসুন্ধরার মাতার কোল আঁকড়ে পড়ে থাকতে চান। কবি বলেন—

…জননী লহো গো মোরে

সঘনবন্ধন তব বাহুযুগে ধরে—

আমারে করিয়া লহো তোমার বুকের

তোমায় বিপুল প্রাণ বিচিত্র সুখের

উৎস উঠিতেছে যেথা কে গোগালপুরে 

আমাকে লয়ে যাও-রাখিয়োনা দূরে।

কবি তাঁর মনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ ও বাক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে কবিতাকে লিরিকের ফল্গুস্রোতে প্রবাহিত করেছেন। বসুন্ধরা মাতার প্রতি তাঁর আবেগ প্রতিফলিত হয়েছে আলোচ্য কবিতায়। যেমন—

‘হে সুন্দরী, তোমা-পানে চেয়ে 

কতবার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে

প্রকাণ্ড উল্লাস ভাব ; ইচ্ছা করিয়াছে— 

সবলে আঁকড়ি ধরি এ বক্ষের কাছে

সমুদ্র মেঘলা-ঝরা তব কটিদেশ।

ছন্দ নির্মাণে কবির স্বাভাবিক স্বকীয়তার প্রতিফলন ঘটছে। আলোচ্য কবিতায় অক্ষর বৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ করি।

ছন্দের পাশাপাশি অলংকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে শব্দালংকার নয় উপমা যমক প্রভৃতি অলংকারের সচেতন প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। ধ্বনিসাম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনুপ্রাস যেমন গুরুত্ব পায় তেমনি সাধুভাষা যাকে আমরা অনেক সময় রাবীন্দ্রিক ভাষাও বলে থাকি, উদ্দিষ্ট কবিতায় তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। অন্তমিল প্রায় একটি চরণেই বর্তমান। তা ছাড়াও প্রতিটি শব্দের সঙ্গে প্রতিটি শব্দের মিল ঘটিয়েছেন, যেমন—

“……..হিল্লোলিয়া, মর্মরিয়া,

বাম্পিয়, স্খলিয়া, বিকিরিয়া বিচ্ছুরিয়া, 

শিহরিয়া, সচকিয়া, আলোকে পুলকে,

প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে।

এই অলংকার শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকেনি চূড়ান্ত গীতিময় পরিবেশেও সৃষ্টি করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন অলংকারের পরিচয় পাই।

চিত্রকল্প কবিতাটির প্রাণ, বসুন্ধরা মাতৃমূর্তিরূপ ও তার কোল আঁকড়ে পড়ে থাকার বাসনা অসাধারণ চিত্রকল্পের সমন্বয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

‘আমার পৃথিবী তুমি

বহু বরষের, তোমার মৃত্তিকা সনে 

আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে 

অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ 

সবিতৃমণ্ডল, অসংখ্য রজনিদিন

যুগ-যুগান্তর ধরি, আমার মাঝারে 

উঠিয়াছে তৃণ তব, পুষ্প ভারে ভারে 

ফুটিয়াছে, বর্ষণ করেছে তরুরাজি

পাত্রফুলফল গন্ধ রেণু,

বসুন্ধরা কবিতায় ধ্বনি ঝঙ্কারময় শব্দ চয়ন কবিতার গীতিময়তা সঞ্চারে সমর্থ হয়েছে। যেমন—অনন্তকুমারীব্রত, নিশিদিনমান ইত্যাদি। স্তবক ও পঙক্তির বিন্যাসের ক্ষেত্রেও এই কবিতা অসাধারণ। ভাবের প্রবাহমানতা চরণ থেকে চরণে সঞ্চারিত হয়েছে এবং বিষয়বস্তুর শিল্পসার্থকতা দান করেছে। বসুন্ধরা মাতার সান্নিধ্য পাওয়ার আকুলতা, এবং এ পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যাওয়ার বাসনা ব্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এই কবিতাতে একদিকে বিশ্বপ্রীতি এবং অন্যদিকে আত্মপ্রীতি কবিতার ভাব ও আঙ্গিক গঠনে সহায়ক হয়েছে।

অনার্স বাংলা পঞ্চম পত্রের সব প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment