মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে আলোচনা করো? লীগ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম থেকে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে লীগের সম্পর্ক কিরূপ ছিল?

মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা

উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে আলিগড় আন্দোলনের নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভাবধারা প্রচার করলে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপট ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সম্প্রদায় নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। এই দলের রাজনৈতিক কার্যকলাপে চূড়ান্ত পরিণতি হলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ভারতবর্ষের দ্বিখন্ডিত হয়ে পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি।

১. প্রেক্ষাপট

(১) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সিমলার বড়লাট লর্ড মিন্টো সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। এই সময় তারা একান্ত আলোচনায় উপলব্ধি করেন যে, সরকারের কাছে মুসলিমদের দাবি দেওয়া জানানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের একটি সংগঠন করে তোলা দরকার।

(২) কথিত আছে যে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সিমলার লর্ড মিন্টো সঙ্গে দেখা করলে মিন্টো তাদের একটি মুসলিম সংগঠন গড়ে তোলা পরামর্শ দেন।

(৩) ঢাকায় নবাব সালিমুল্লাহর ডাকে হাজার ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় একটি সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ৩০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সারা ভারতে মুসলিম লীগ গঠিত হয়। লীগের প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হন আগা খাঁ।

২. উদ্দেশ্য

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য গুলি ছিল-

(১) ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন।

(২) মুসলিমদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করা।

(৩) জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দুদের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করা।

(৪) কংগ্রেস বিরোধী অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রীর প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি।

৩. প্রসার

প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ দ্রুত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। দেশে বিভিন্ন প্রদেশের এর শাখা গড়ে ওঠে। লীগের দাবির ভিত্তিতে মর্লে মিন্টো আইনের 1909 খ্রিস্টাব্দের দ্বারা মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়, অর্থাৎ শুধু মুসলিমদের দাঁড়াই আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ আরও বৃদ্ধি পায়।

ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে লীগের সম্পর্ক

প্রতিষ্ঠার পর থেকে কিছুদিন মুসলিম লীগ কংগ্রেস ও বিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধীতা যে সক্রিয়তা দেখিয়েছিল তা কিছুকাল পর পরিবর্তিত হয়। মোটামুটি ভাবে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। এই পর্বে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে লীগের সম্পর্ক নিচে উল্লেখ করা হলো-

১. বঙ্গভঙ্গ রদ

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাগ করে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ পৃথক পূর্ববঙ্গ আসাম প্রদেশের সৃষ্টি হলে মুসলিম সম্প্রদায় খুশি হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তীব্র আন্দোলনের ফলে সরকার ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দুই বাংলা আবার যুক্ত করতে বাধ্য হয়। ফলে ঢাকা কেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গের মুসলিম আধিপত্যের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য মুসলিম সম্প্রদায় সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।

২. প্রগতিশীল নেতৃত্ব

এতদিন মুসলিম লীগের আলিগড়ের নেতাদের আধিপত্য ছিল। প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পর একদল প্রগতিশীল তরুন মুসলিম নেতা মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মৌলনা মোহাম্মদ আলী, মৌলোনা সৌকত আলী, মোহাম্মদ আলী জিন্না, হাকিম আজমল খান, মৌলোনা আবুল কালাম আজাদ, হযরত মহানি প্রমুখ। নতুন এই যুব নেতাদের ঘোষণা করেন যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে সামিল হয়ে ভারতে স্বায়ত্ত শাসন লাভই তাদের প্রধান লক্ষ্য।

৩. লক্ষ্ণৌ চুক্তি

লীগের তরুণ নেতাদের প্রচেষ্টায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রতিক পরিবেশ তৈরি হয়। এর ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রে,

(১) কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যৌথভাবে সরকারের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি জানাবে।

(২) কংগ্রেস স্বরাজের আদর্শ লীগ মেনে নেবে।

(৩) লীগের পৃথক নির্বাচনের দাবি কংগ্রেস মেনে নেবে।

(৪) প্রতিটি প্রাদেশিক আইনসভার মুসলিম সদস্যদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হবে।

(৫) কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের এক তৃতীয়াংশ সদস্য মুসলিম হবেন। ডক্টর বিপান চন্দ্র মনে করেন যে, লক্ষ্ণঔ চুক্তি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

৪. খিলাফৎ আন্দোলন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪-১৮ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কর পরাজিত হলে ব্রিটেন তুরস্কর এর ব্যবচ্ছেদে এবং তুরস্কের খালিফার ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ নেই। ভারতীয় মুসলিমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই আন্দোলনে শামিল হয়।

৫. অসহযোগ আন্দোলন

গান্ধীজী ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন এবং স্বরাজের দাবি জানান। কংগ্রেসের এই আন্দোলন ও দাবির প্রতি মুসলিম লীগ সমর্থন জানায়। এর ফলে হিন্দু-মুসলিম সংহতি বৃদ্ধি পায় এবং সাময়িকভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক বিভেদ হ্রাস পায়।

উপসংহার

অসহযোগ ও খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধ হওয়ার কিছুকাল পর ভারতীয় রাজনীতি হিন্দু মুসলিম বিভেদ পুনরায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। মৌলানা আসাদ ছাড়া সকল খিলাফৎ নেতা গান্ধীজিকে ত্যাগ করে। আলী ভ্রাতৃদ্বয় মৌলানা মোহাম্মদ আলী ও মৌলানা সৌকত আলী ঘোষনা করেন যে, তারা প্রথমে মুসলিম, পরে ভারতীয়। এই সময় দেশের নানা স্থানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ৭২ টি সম্প্রদায়ের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment